ব্যাংকিং খাতে নয় মাসের চিত্র: ৬৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে তারল্য

ব্যাংকিং খাতে নয় মাসের চিত্র: ৬৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে তারল্য

দেশের ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহ বা তারল্যের পরিমাণ কমছেই। গত নয় মাসে তারল্য কমেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে তারল্য কমেছে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর আগে করোনার সময়ে ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল। এরপর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত তারল্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। গত জুনের পর থেকে নিুমুখী প্রবণতা শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত। ডিসেম্বর ও জুনে ব্যাংক ক্লোজিংয়ের সময়ে সাধারণত তারল্য বৃদ্ধি পায়। গত ডিসেম্বরে তারল্য বাড়েনি। বরং কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার জন্য ছয়টি কারণকে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে করোনার পর হঠাৎ ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে গ্রাহকদের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এছাড়া আমানত, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার বিষয়টিও চিহ্নিত হয়।

ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় বেশি এবং সংকটের কারণে বাড়তি দামে ডলার কেনায় ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়েছে বেশি। বিপরীতে ব্যাংককে টাকা জমার প্রক্রিয়াগুলো ধীর হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঋণ থেকে আদায় বাড়েনি। আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। এতে করেই তারল্য কমে যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সর্বোচ্চ ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে তারল্য ওঠানামা করেছে। গত বছরের জুন থেকে তারল্য কমা শুরু করেছে। গত বছরের জুনে ব্যাংককে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। জুলাইয়ে তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকায়। এক মাসে তারল্য কমেছে ২০ হাজার টাকা। আগস্টে তারল্য আরও কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায়। ওই এক মাসে কমেছে ৪ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তারল্য আরও কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায়। ওই মাসে কমেছে ২ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবরে তারল্য ছিল ৪ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরে কমে হয় ৪ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

ডিসেম্বরে আরও কমে ৩ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায়। ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের নানা লক্ষ্যমাত্রা থাকে। এগুলো পূরণ করলে ব্যাংকারদের পনোদন্নতির ক্ষেত্রে একটি পয়েন্ট যোগ হয়। যে কারণে তারা ওই সময়ে আমানত বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তারপরও ডিসেম্বর শেষে তারল্য বাড়েনি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে তারল্য আরও কমে ৩ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নামে। ফেব্র“য়ারিতে কমে হয় ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। মার্চে সাময়িকভাবে হিসাবে তারল্য আরও কমে দাড়ায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায়। ওই মাসে কমেছে ৩ হাজার কোটি টাকা।

প্রচলিত নিয়মে ব্যাংকে ঋণের চেয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ পরিস্থিতি উল্টে গেছে। এখন আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে আমানত বেড়েছে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এর বিপরীতে ঋণ বেড়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়েছে বেশি, ব্যাংকে এসেছে কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছিল ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ঋণ বেড়েছিল ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ওই অর্থবছর থেকেই তারল্য কমার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।

২০১৫ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ গ্রহীতাদের নানা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে এ ছাড়ের পরিধি আরও বেড়েেেছ। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দায় এ ছাড় আরও বেড়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো আদায় হয়েছে কম।

ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো কিনে নিয়ে বাজারে নতুন টাকা ছাড়ে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগে নিুমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমায় টাকার জোগানও কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই এপ্রিলে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল সোয়া ১৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই এপ্রিলে রফতানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ রেমিট্যান্স থেকে তারল্য প্রবাহ গত অর্থবছর থেকেই কমছে। রপ্তানি আয় কমছে চলতি অর্থবছর থেকে। করোনার সময় থেকেই বৈদেশিক বিনিয়োগে মন্দা চলছে। এ কারণে এ খাতেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়েনি।

গত বছরের ২৪ ফেব্র“য়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করে। এর পর থেকে দেশে ও বিদেশে পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এতে আমদানি ব্যয়ও বাড়ে। ফলে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়। গত মে মাসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তারপরও ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১১০ টাকায় উঠেছে। কারণ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমেছে। বিপরীতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে ডলারের খরচ বেড়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আমদানি ব্যয় মেটায়। এতে ব্যাংকের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে বাজারে প্রবাহ কমে যায়। চলতি অর্থবছরের ৩ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি ডলার বিক্রি করে। এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চলে যায় প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হচ্ছে।

গত বছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি রপ্তানিতে অর্থায়ন ডলার ও টাকায় সমান হারে বাড়ছিল। কারণ ওই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল ছিল। গত বছরের মার্চের পর ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ফলে টাকার হিসাবে ঋণ ১৯ শতাংশ বাড়লেও ডলারের হিসাবে তো ঋণ বাড়েইনি। উলটো কমেছে দশমিক ৫ শতাংশ।

কয়েকটি ব্যাংককে নানা অনিয়মের কারণে গ্রাহকরা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। এছাড়া পণ্যের দামের কারণে সংসার খরচ মেটাতে গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পরিমাণ বাড়িয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্র“য়ারিতে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রেখেছিলেন ২৭৫৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ২১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা হয়েছে। গ্রাহকদের টাকা তোলার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৭ গুণ বেড়েছে। এসব মিলে ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ কমে যাচ্ছে।