হাসিনার কারচুপির নির্বাচনের বিরুদ্ধে একাট্টা পশ্চিমাবিশ্ব

হাসিনার কারচুপির নির্বাচনের বিরুদ্ধে একাট্টা পশ্চিমাবিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুশফিকুল ফজল আনসারী 

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর নজিরবীহিন কারচুপির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত এ নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে ক্ষোভ, সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বইছে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছে বলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীনরা মুখে খই ফোটালেও এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে গণতন্ত্রপ্রিয় পশ্চিমাবিশ্ব।

বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদান, অব্যাহত সন্ত্রাস ও ভোট কারচুপির সুষ্ঠু তদন্ত এবং সুরাহার তাগাদা দিয়ে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বিতর্কিত সরকার প্রধান ও প্যাথলজিক্যাল লায়ার শেখ হাসিনা অবশ্য স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নির্বাচন নিয়ে মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছেন। ভোট জালিয়াতির জ্বলন্ত প্রমাণ বিবিসি সাংবাদিক কর্তৃক তার সামনে উত্থাপনের পর তিনি বিষয়টিকে ধামাচাপা দেবার জন্য জালিয়াতির ঘটনাটি অন্য নির্বাচনের বলে চালিয়ে দিতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। বিবিসি পরে বিষয়টি নিয়ে পুনরায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

বাংলাদেশ নির্বাচন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে মঙ্গলবার কড়া বার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নির্বাচন নিয়ে সরকারকে ‘স্বাগত’ না জানিয়ে বরং তারা অনিয়ম, কারচুপি এবং সহিংসতার ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করার জোরালো আহবান জানিয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব শক্ত ভাষায় তাদের যে মূল্যায়ন এবং অবস্থান তোলে ধরেছে তাতে বেকায়দায় তথাকথিত বিজয়ী শেখ হাসিনা। বুধবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়টার্স তাদের এক প্রতিবদনে এমন অভিমত তোলে ধরেছে। 

‘ওয়েস্টার্ন পাওয়ার কলস ফর প্রোব ইনটু বাংলাদেশ ইলেকশন ইরেগুলারিটিস, ভায়োলেন্স’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন চলাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমাবিশ্ব। যে নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন জোট ৯০ শতাংশের বেশী আসনে জয়ী হয়েছে সে ভোটে সংগঠিত কারচুপির অভিযোগগুলো নিয়েও সবিস্তারে কথা বলেছে পশ্চিমাদেশগুলো।”

নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব কড়া ভাষায় তাদের যে মূল্যায়ন তোলে ধরেছেন সেটি শেখ হাসিনার ভাবমূর্তির ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ব্যাপক কারচুপি আর ভোটারদের আতংকিত করে নির্বাচন করা হয়েছে অভিযোগ এনে এর ফলাফল প্রত্যাখান করেছে শেখ হাসিনার বিরোধী সকল রাজনৈতিক দল। তবে অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন শেখ হাসিনা। তার ভাষ্যমতে ভোট ছিলো শান্তিপূর্ণ, আর তাতে উৎসব মুখর পরিবেশে অংশ নিয়েছেন তার সমর্থকরা।”

দেশে চলমান পরিস্থিতির দিকে ইংগিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “মঙ্গলবারের ঢাকার পরিস্থিতিটা ছিলো চুপচাপ। তবে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলার শিকার হচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদরে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছে, “নির্বাচনের দিনে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াজুড়ে ছিলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ঘাটতি। এসকল প্রতিবন্ধকতার কারণেই নির্বাচনের প্রচার এবং ভোটদান প্রক্রিয়া কলুষিত হয়েছে।”

“নির্বাচনে অনুষ্ঠিত কারচুপির অভিযোগসমূহের একটি যথার্থ তদন্ত করার” আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি।

বিদেশে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও এ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে দেশটি জানিয়েছে, “হয়রানি, ভীতিকর পরিস্থিতি এবং সহিংস কর্মকান্ডের জন্যই নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বিরোধী দলের প্রার্থী এবং সমর্থকেরা স্বাধীনভাবে তাদের সভা-সমাবেশ করতে পারেনি, কোনো প্রচারণা চালাতে পারেনি। এঘটনাগুলোর স্বপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে, আর তাতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র।”

ভোটে বাধা দেবার বিষয়টিতে অসন্তোষ জানিয়ে দেশটি বলেছে, “ভোটের দিনে সংগঠিত অনিয়মগুলোর কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। এ বিষয়টিতে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।কারচুপির এসব বিষয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”

একই উদ্বেগ প্রতিধ্বনিত হয়েছে যুক্তরাজ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ডের বিবৃতিতেও। তিনি বলেন, “যেসকল বাধা কিংবা গ্রেফতারের মতো ঘটনার কারণে বিরোধীদলসমূহ নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেনি সে বিষয়ে আমি অবগত।”

মার্ক বলেন, “নির্বাচন কর্মকান্ড নিয়ে যেসকল অভিযোগ এসেছে সেগুলোর একটি পরিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ সমাধানের আহবান জানাচ্ছি।”

পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী নির্বাচনের দিন শেখ হাসিনার সমর্থক এবং বিরোধী নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, নতুন আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে ভোট কারচুপির তথ্যগুলো জমা করছেন তিনি। এ নিয়ে একটি স্মারক নির্বাচন কমিশনে হস্তান্তর করা হবে। নতুন কোনো নির্বাচন করা যাবে না- নির্বাচন কমিশন এমনটা বললেও আলমগীর বলছেন-“এ ছাড়া (নির্বাচন) বিকল্পটা কী?”

নির্বাচনের রেশ না ফুরোতেই এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করা দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক স্থানীয় সরকারী কর্মকতা। ভুল তথ্য দেবার অভিযোগ এনে মামলাটি করা হয়েছে কিছু দিন আগে পাস করা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে। বিরোধী কন্ঠ দমনে এই আইন করা হয়েছে বলে বিতর্ক রয়েছে।"

খুলনার একটি আসনে নিবন্ধিত ভোটারের চাইতে বেশী সংখ্যা দেখিয়ে ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়েছে-এরকম একটি প্রতিবেদন করার অভিযোগে হেদায়েত হোসেন মোল্লা এবং রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলাটি করা হয়েছে। হেদায়েত হোসেনকে মঙ্গলবারই আটক করেছে পুলিশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাণহানির মাধ্যমেই নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার অবসান ঘটলো দেশটিতে। বিরোধীপক্ষের দাবি তাদের নেতা-কর্মীদের কারণ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হামলা চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা।

ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীতে ৪ সন্তানের জননীকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দ্বারা সংঘবদ্ধ গণধর্ষণের খবর ইতিহাসের সকল পাশবিকতাকে হার মানিয়েছে।

বাংলাদেশের সহিংসতার ঘটনার একটি পক্ষপাতহীন তদন্তের আহবান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি।

তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের শারীরিকভাবে নির্যাতিত হবার ঘটনাগুলো আমরা শুনেছি, ভোট কেন্দ্রগুলোতে আক্রান্ত হবার কথাও জেনেছি।”

বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলছিলো বড়দিন এবং নববর্ষের ছুটি। নির্বাচন শেষ হওয়ার ২৪ ঘন্টার ভিতরে ছুটির মধ্যেও সহিংসতায় প্রাণহানি এবং বিরোধীপ্রার্থী ও ভোটারদের নির্বাচনে বাধা প্রদানে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। প্রাণহানির ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশ করে সংস্থাটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সংগঠিত অনিয়ম আর সহিংসতার ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবগত আছে জাতিসংঘ। নির্বাচনী প্রচারণা আর নির্বাচনের দিন সহিংসতায় যেসকল প্রার্থী এবং ভোটার হতাহত হয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।”

নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ আইনীভাবে সমাধানের তাগিদ দিয়ে মহাসচিবের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, “শান্তিপূর্ণ পন্থায় এবং আইনী প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নির্বাচনে ঘটে যাওয়া অনিয়মের বিষয়গুলো সমাধান করতে সকল দলকে আহবান জানাচ্ছে জাতিসংঘ।”

জিএস