সহসা ফিরছে না রোহিঙ্গারা

সহসা ফিরছে না রোহিঙ্গারা

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হয়। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। আর তার আগে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে তিন লাখ রোহিঙ্গা। সবমিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। গত বছর জানুয়ারিতে সম্পাদিত ঢাকা-নেপিদো প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া, জাতিসংঘ,অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল,যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন সংস্থা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছে, রাখাইন এখনও রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ নয়। কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গাদের একাংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তটিরও সমালোচনা করছে অ্যামনেস্টিসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

জাতিসংঘ দূত দ্বীপটিতে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও অন্যান্য ভবন পরীক্ষা করে দেখেন। চলতি সপ্তাহেই মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড সফর করার কথা রয়েছে তার। ভাসানচর থেকে ফেরার পর ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার যে মিয়ানমার এখনও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করেনি। তারা সেখানে হয়রানি ও নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। ফলে বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা নিশ্চিতভাবেই খুব শিগগিরই দেশে ফিরে যেতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারকে আহ্বান জানাবো তারা যেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এবং স্থানীয়দের এই বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করুন।’

ভাসানচর নিয়ে ইয়াংঘি লি বলেন, সরকার এই দ্বীপ তৈরিতে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। তারপরও আমি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘জনমানবপূর্ণ এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে। কোনও রোহিঙ্গার সম্মতি ছাড়া এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে না বলেও সতর্ক করেন ইয়াংঘি লি।

মাত্র ২০ বছর আগেই সাগর থেকে ভাসানচর দ্বীপটির উৎপত্তি। নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে এক ঘণ্টা নৌকাপথ অতিক্রম যেতে হয় দ্বীপটিতে। সেখানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ২৮ কোটি ডলার ব্যয় করছে বাংলাদেশ। সেখানে প্রায় একলাখ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে চায় সরকার। তবে দ্বীপটিতে বৈরী আবহাওয়ার শিকার হয়ে বিগত বছরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও দ্বীপটিতে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘও জানিয়েছে স্থানান্তর অবশ্যই স্বেচ্ছামূলক হতে হবে।

২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ২২৫১ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। মিয়ানমার টাইমস সে সময় দাবি করে, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাখাইনে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। লি’র সফরকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মিয়ানমার ৬০০ জনকে প্রত্যর্পণের তাগিদ দিয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দু ধর্মালম্বী পরিবারের সদস্য। ৮ জানুয়ারি মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মানজুরুল করিম খান চৌধুরীকে এই তালিকায় দিয়ে দ্রুত প্রত্যর্পণের তাগিদ দেয়।

১৯৮২ সালে মিয়ানমারে নাগরিকত্বের নতুন আইন প্রণীত হওয়ার আগে সবুজ পরিচয়পত্রে পুরুষ ও গোলাপী পরিচয়পত্রই ছিল মিয়ানমারে বসবাসকারী নিজ দেশের মানুষদের শনাক্ত করার উপায়। সেই পরিচয়পত্র ছিল রোহিঙ্গাদের কাছেও। তখন তারাও স্বীকৃত ছিলেন মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রসিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি। ধাপে ধাপে রঙ-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। রোহিঙ্গাদের পরিচয় এখন একটাই: পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন শরণার্থী জনগোষ্ঠী।

কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদেরকে বেশিরভাগ রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বিবেচনা করে। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ ঘৃণার চাষাবাদ করেছে দীর্ঘদিন। বিদ্বেষের শেকড় তাই দিনকে দিন আরও শক্ত হয়েছে। রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী কর্তৃক বুলডোজার চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত নষ্ট, সামরিক ঘাঁটি নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ নির্মাণ চলমান থাকা সত্ত্বেও এখনও মিয়ানমার বলে যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চলমান রয়েছে।