ভারতের কাশ্মীর পদক্ষেপের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

ভারতের কাশ্মীর পদক্ষেপের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার ভারতের পদক্ষেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সরকার ভূ-কৌশলগত নীতির বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে যাচ্ছে, যা আগামী কয়েক মাসজুড়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রকাশ পাবে।

যদিও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ অনেক কারণ দেখিয়ে ৩৭০ ধারার কারণে কাশ্মীরে যেসব নেতিবাচক প্রভাব ছিল সেগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, তারপরও দ্রুত এ পরিবর্তনের প্রকৃত কারণ নিহিত রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে।

কাশ্মীরকে ভারতের কেন্দ্রশাসিত ভূখণ্ডে রূপান্তর করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তার ঘোষণা প্রদান করার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদের পক্ষ থেকে একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, কাতারের দোহায় তালেবানদের সঙ্গে তার আলোচনায় ‘বড় ধরনের অগ্রগতি’ হয়েছে এবং তিনি দিল্লি আসছেন আফগানিস্তানে শান্তির পক্ষে বড় ধরনের মতৈক্য তৈরি করার জন্য।

আফগানিস্তানের শান্তির পক্ষের কর্মীদের তালেবানরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি চূড়ান্ত (এখন পর্যন্ত) করা হয়েছে এবং উভয় পক্ষ আশা করছে, এ সপ্তাহান্তের আগেই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা যাবে।

এর আগে তালেবানরা চাচ্ছিল ৯ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বহু দেনদরবারের পর এটিকে ১৫ মাসে সমাধা করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, ২০২০ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ট্রাম্পের মূল কার্ড হবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি।

তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এ শান্তি চুক্তির নিহিতার্থ দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলজুড়ে অনুভূত হবে। এটি হবে একটি তৈরি স্বীকারোক্তি যে, বুশ জুনিয়র ও ওবামা প্রশাসনের গত দু’দশকের আফগান নীতি ব্যর্থ হয়েছে এবং আফগান যুদ্ধে তালেবানরা হবে বিজয়ী।

এটি একটি ল্যান্ডমার্ক হবে পাকিস্তানের জন্যও। ভারত কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা তুলের নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রথমে চুপ করে ছিলেন। সম্ভবত পাকিস্তান উৎকণ্ঠার সঙ্গে এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত সম্পদ- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছে।

১৯৮০-এর দশকে ফিরে তাকানোর মতো তালেবানদের হাতে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৮৮ সালের ১৪ এপ্রিল জেনেভা চুক্তির পর দক্ষিণ এশিয়া একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে যায়, যখন আফগান মুজাহিদ যোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষণ করা সম্পদের কিছু অংশ কাশ্মীরে ব্যবহার করার চেষ্টা করছিল পাকিস্তান। কারণ সেখানে কয়েক বছরের সহিংসতার মাধ্যমে তৈরি বিদ্রোহ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

নীরব কূটনীতিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। আফগান মুজাহিদিনদের একটি অংশ ভারত এবং রাজীব গান্ধী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। ভি পি সিং ও পি ভি নরসিমা রাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, যা তারা ভারতের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তুলনামূলক বিচারে ভারত এখন পর্যন্ত তালেবানদের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো আলোচনার প্রস্তাব করেনি, যে বিষয়টিতে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছে পাকিস্তান।

তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির তাৎক্ষণিক ফল হবে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থহীনতার দৃশ্যমান প্রকাশ। গত দু’দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্পর্শকাতর ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে ছিল। যখন যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক সামরিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছুক, তখন এটি অবশ্যম্ভাবী যে, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে।

এ প্রেক্ষাপটেই কাশ্মীরের ওপর নিজেদের মুষ্টি শক্ত করছে ভারত। তবে ইস্যুটি হল, যদি পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসী হামলাকে সহায়তা করতে চায়, যেমনটি দেশটি করেছে ১৯৯০-এর দশকে, যখন ইসলামাবাদের প্রভুদের সমর্থন পেয়ে লস্কর-ই-তৈয়বা বড় ধরনের সন্ত্রাসী শক্তিতে পরিণত হয়। আগামী মাসগুলো ভারতের জন্য কঠিন হতে যাচ্ছে, অন্তত তেমনটিই মনে করা যায়।

১৯৯০-এর দশকটি ছিল অস্থিরতায় ভরা। এ সময়টিকে ম্যানেজ করা হয়েছে আবদুল্লাহ, মুফতিদের মতো স্থানীয় কাশ্মীরি রাজনীতিবিদ এবং জঙ্গিদের ভেতরকার সোর্সের সহায়তার মাধ্যমে, যারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের অঙ্গীভূত কাশ্মীরে একই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছিল। কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ সীমাবদ্ধ হওয়ায় ‘পুরনো’ কাশ্মীরি শাসকদের বংশপরম্পরার লোকেরা এখন কী ভূমিকা পালন করবে, এবং কাশ্মীরের রাজনীতির ময়দানে ভারতের নতুন আবিষ্কার কারা হবে, তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।

তবে ভারত কাশ্মীরে নির্বিঘ্নে ছড়ি ঘুরাতে পারবে কেবল তখনই, যখন পাকিস্তান নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নেবে। নিজেদের তালেবান ফ্রন্টে বড় ধরনের কৌশলগত বিজয় লাভের পর তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলা যায়।

কাবুলের আশরাফ গনি সরকারের ওপর তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির কী প্রভাব পড়ে এখন সেটাই দেখার বিষয়। যে সরকার আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষমতার বৈধতা নবায়ন করে নিতে চায়, যদিও তালেবানরা এর বিরোধিতা করেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, ভারত একটি পদক্ষেপ নিয়েছে; তবে দেশটি এখনও তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন থেকে অনেক দূরে আছে, যে লক্ষ্য নিহিত আছে এমন শক্তিগুলোর ছায়ার নিচে, যারা ভারতের নিয়ন্ত্রণের অনেক বাইরে। দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর

এমজে/