গুলি নয়, ভারতীয় সেনাদের ‘অদ্ভুত’ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে চীনা সেনারা

গুলি নয়, ভারতীয় সেনাদের ‘অদ্ভুত’ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে চীনা সেনারা

প্রায় চার ফুট লম্বা লোহার রড। রডের মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত সারি সারি পেরেকের মতো ধারাল কাঁটা লাগানো। এমন বেশ কিছু কাঁটা লাগানো লোহার রড উদ্ধার করা হয়েছে গলওয়ানে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে চীনা সেনাদের সংঘর্ষস্থল থেকে।

ভারতীয় সেনা সূত্রে দেশটির গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ওই অস্ত্র দিয়েই চীনা বাহিনী আক্রমণ করেছিল ভারতীয় সেনাদের। সেনা কর্তাদের দাবি, ‘ক্লোজ কমব্যাট’ বা হাতাহাতি’র পর্যায়ে এ ধরনের রডের আঘাত আগ্নেয়াস্ত্রর থেকেও বেশি প্রাণঘাতী।

উধমপুর সেনা হাসপাতাল এবং লেহ-র জেলা হাসপাতালে ভর্তি জওয়ানদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন সেনা কর্তারা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রায় এক কোম্পানি জওয়ান (১০০ থেকে ১২০ জন) চীনা বাহিনীর হামলার মুখে পড়েন। তাঁদের বক্তব্য এই হামলা ছিল পরিকল্পিত। আগে থেকে পরিকল্পনা করেই ঘিরে ফেলা হয় ভারতীয় জওয়ানদের এবং সংখ্যায় ভারতীয় জওয়ানদের তুলনায় চীনা জওয়ানদের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে চার থেকে পাঁচগুণ। পুরোপুরি এক তরফা হামলায় চীনা বাহিনী এলোপাথাড়ি আঘাত করে ওই ধরনের কাঁটা লাগানো রড দিয়ে।

যে চার জন জওয়ানের অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং তাদের অবস্থা স্থিতিশীল। সেনাদের বেশির ভাগেরই মাথায় আঘাত। তারা এক থেকে দু’সপ্তাহের মধ্যে ফের কাজে যোগ দিতে পারবেন বলে জানা গিয়েছে সেনা সূত্রে।

এদিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা প্রশমনের জন্য বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আবারো দুই বাহিনীর মেজর জেনারেল পর্যায়ে বৈঠক শুরু হয়েছে। চিশুল সীমান্তের উল্টোদিকে চীনের মলডোতে এই বৈঠক চলছে। বুধবারও বৈঠক হয়েছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। কিন্তু সেই বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয় নি। অমীমাংসিত থাকে বৈঠক। ভারতের পক্ষে বৈঠকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেজর জেনারেল হরীন্দ্র সিংহ।

উত্তেজনা প্রশমনের জন্য দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তার মধ্যেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সামরিক প্রস্তুতি তুঙ্গে দু’পক্ষেরই। নয়াদিল্লি থেকে সেনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘লজিস্টিক’অর্থাৎ রসদ কেনার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি কী ভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা স্থানীয় স্তরেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে।

তারপরই নিয়ন্ত্রণ রেখায় মোতায়েন সেনাকর্মীদের জন্য ‘বডি আরমার’ বা এক বিশেষ ধরনের বর্মের মতো পোশাক পাঠানো হচ্ছে। সাধারণত আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ যে ধরনের বিশেষ বর্ম পোশাক পরে অনেকটা সেই ধরনের পোশাক। তবে এই পোশাক ধারাল অস্ত্র্রের আঘাত রুখতে পারবে। সোমবার রাতের সংঘর্ষের কারণেই এ ধরনের প্রস্তুতি।

এদিকে লাদাখ সীমান্তে ভারত-চীন সেনাদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায়, বেইজিং-এর বিরুদ্ধে কলকাতায় বিক্ষোভ হয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও। সীমান্তে সংঘর্ষে ভারতের নিহত ২০ জওয়ানের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দুই সেনা সদস্য রয়েছেন।

কলকাতা থেকে প্রায় তিনশ কিলোটিমার দূরে বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া গ্রামের বাসিন্দা রাজেশ ওরাং। চলতি মাসে বিয়ের কথা চলছিল এ সেনা সদস্যের। কিন্তু সোমবার লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনা সেনাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ হারান ২৫ বছর বয়সী তরুণ সেনা রাজেশ।

এদিকে চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সংঘাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে, উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস এ আহ্বান জানান।

এর আগে ভারত-চীন সীমান্তের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সোমবার দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে ভারতের অন্তত ২৩ সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্তনিও গুতেরেসের পক্ষে তার মুখপাত্র এরিক কানেকো বলেন, আমরা ভারত ও চীনের মাঝামাঝি সীমান্ত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে (এলএসি) সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং উভয়পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি। তবে এটা ইতিবাচক যে, উভয় দেশ উত্তেজনা নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছে।

এর আগে, ১৯৭৫ সালে ভারত-চীন সীমান্তে শেষবার কোনও সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর থেকে ওয়েস্টার্ন সেক্টরে লাদাখে বা ইস্টার্ন সেক্টরে অরুণাচলে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি-মারামারি কম হয়নি। কিন্তু এ ধরনের প্রাণঘাতী মারামারি কখনও হয়নি।

তবে এই সংঘাতে কোনও পক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। লোহার রড, লাঠি, পাথর নিয়ে হামলা করেছে চীনা সেনা। তারপরই প্রত্যাঘাত করেছে ভারতীয় সেনারা।

ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ দুটি বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্তে ভারী অস্ত্র মজুত করেছে। পূর্ব লাদাখের সীমান্ত অঞ্চলে ধীরে ধীরে এসব অস্ত্র নিয়েছে দুই দেশ। ভারী অস্ত্রের মধ্যে কামান এবং যুদ্ধের গাড়িও রয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ বিরাজ করায় এসব অস্ত্রের মজুত করা হয়েছে।

কিছুদিন আগে ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, চীন সেনাবাহিনী সীমান্তের যে এলাকায় রয়েছে সেখান থেকে ভারতের অংশে ঢুকতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা লাগবে। লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের বিভিন্ন জায়গায় ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে চীনা বাহিনী।

ভারতীয় সূত্রের বরাতে খবরে বলা হয়, চীনের সেনাবাহিনী লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের কাছের ঘাঁটিগুলিতে নানান যুদ্ধের গাড়ি ও ভারী যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। বিষয়টি জানতে পেরে ভারতও আর্টিলারের মতো অস্ত্র ওই এলাকায় পাঠিয়েছে।