বিশ্বে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ দেশ

বিশ্বে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ দেশ

এ বছর মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ১০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকা করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। অর্থনীতি বিষয়ক বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের ভারতীয় সংস্করণে দেশগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে আছে দক্ষিণ সুদান (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৪৯২.৭২ ডলার), বুরুন্ডি (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৯৩৬.৪২ ডলার), মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১১৪০ ডলার), কঙ্গো (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৫৭০ ডলার), মোজাম্বিক (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৬৫০ ডলার), মালাবি (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৭১০ ডলার), নাইজার (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৭৩০ ডলার), চাদ (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৮৬০ ডলার), লাইবেরিয়া (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৮৮০ ডলার) এবং মাদাগাস্কার (মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৯৯০ ডলার)। এই তালিকায় সবচেয়ে দরিদ্র দেশকে রাখা হয়েছে শুরুতে। এরপর পর্যায়ক্রমে তার চেয়ে একটু কম দরিদ্র দেশগুলোতে স্থান দেয়া হয়েছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কিছু দেশ চরম দারিদ্র্যে ভুগছে। দেশগুলোর মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি হলো ইংরেজি শব্দ গ্রোস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট। এর মাধ্যমে একটি দেশের পণ্য এবং সেবাখাতের উৎপাদনশীলতা বার্ষিক ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয়। এর মাধ্যমে একটি দেশ কতটা ধনী বা গরিব তার একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরা হয় বলে বিবেচনা করা হয়।

একটি দেশের মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে হিসাব পাওয়া যায়, তাই মাথাপিছু জিডিপি বা মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি।

কখনো কখনো মাথাপিছু জিডিপি মূল চিত্রের অংশমাত্র তুলে ধরে। এর কারণ, এক দেশ থেকে আরেক দেশে জীবনধারণের খরচ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অনেক বেশি ভিন্ন হয়। এ জন্য বেশি সুষ্ঠু তুলনীয় মাধ্যম হলো পিপিপি। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বোঝাতে পিপিপি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় জীবন ধারণের খরচ এবং মুদ্রাস্ফীতি দিয়ে বিভিন্ন দেশের মানসম্পন্ন জীবনধারণের অধিক প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। আয়করের কারণে কিছু দেশ কৃত্রিমভাবে জিডিপিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে।

ওই প্রতিবেদনে দক্ষিণ সুদান সম্পর্কে বলা হয়েছে- সেখানে মোট জনসংখ্যা এক কোটি ১২ লাখ ৫ হাজার ৩৮৩। আর জিডিপি ২৫৮৩ কোটি ডলার। এটি বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ দেশ। মাত্র ২০১১ সালে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভয়াবহ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এর অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত করছে রাজনৈতিক অস্থিতিশলীতা, চলমান গৃহযুদ্ধ ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব। বেশির ভাগ মানুষ বেঁচে আছেন প্রচলিত কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে। সহিংসতা ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ু ঘন ঘন সেখানকার কৃষিকাজে বিঘ্ন ঘটায়। এসব কারণে দেশটিকে ঘিরে ধরেছে দারিদ্র্য।

বুরুন্ডির মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৩৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৩৬। জিডিপি ৩০৬ কোটি ডলার। পূর্ব আফ্রিকায় ভূমিবেষ্টিত একটি ছোট্ট দেশ। এখানে আছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এতে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে বড় বাধা। আছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব। দেশটির অর্থনৈতিক সংগ্রাম এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে নাগরিকরা। এর ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠছে। দেশটির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। অন্য সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোর তুলনায় সেখানে আছে উচ্চ মাত্রায় খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা।

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে জনসংখ্যা ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৮। জিডিপি ৩০০ কোটি ডলার। এর অবস্থান মধ্য আফ্রিকায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সশস্ত্র সংঘাত এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবে এখানে দেখা দিয়েছে বড় রকম অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দেশটির সম্পদের মধ্যে আছে স্বর্ণ, তেল, ইউরেনিয়াম এবং ডায়মন্ড। কিন্তু সে তুলনায় দেশটির জনগণকে ব্যাপক দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ভয়াবহ বন্যা এবং তীব্র খরার কারণে সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক বেশি।

কঙ্গোর জনসংখ্যা ১০ কোটি ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৫। জিডিপি ১৫৪২ কোটি ডলার। সাব সাহারান আফ্রিকায় এটিই সবচেয়ে বড় দেশ। কোবাল্ট এবং কপারের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর থাকা সত্ত্বেও দেশটি বড় রকম অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বেশির ভাগ মানুষ বসবাস করেন দারিদ্র্যে। দিনে ২.১৫ ডলারেরও কম অর্থে জীবন ধারণ করেন শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ মানুষ। অপুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুযোগ এবং উচ্চ জন্মহার দেশটির দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। উন্নয়নকে করছে বাধাগ্রস্ত।

মোজাম্বিকের জনসংখ্যা ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৩৬। জিডিপি ২৩৯৬ কোটি ডলার। মোজাম্বিক হলো পর্তুগিজের সাবেক কলোনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্যের মুখে দেশটি। তা ছাড়া আছে নিম্ন পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন এবং সম্পদের অসমতা। ধনী হওয়ার সম্পদ এবং শক্তিশালী জিডিপি থাকা সত্ত্বেও তারা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দেশটির উত্তরে ইসলামপন্থি বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হামলায় তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মালাবির মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৫। জিডিপি ১১০৪ কোটি ডলার। এর চমৎকার দৃশ্যপট রয়েছে। অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায়। বড় রকমের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তারা। বৃষ্টিনির্ভর কৃষিকাজের ওপর মূলত নির্ভরশীল দেশটি। কিন্তু তাতে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে আছে। নিত্যপণ্যের দাম উঠানামা করে। তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বৈচিত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার।

নাইজারের মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার ৭৪০। জিডিপি ১৯৫৪ কোটি ডলার। ভূমিবেষ্টিত পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ নাইজার। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, ঘন ঘন খরা এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি জোরালো থাকায় বড় রকমের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং উচ্চ দারিদ্র্যের হার লক্ষণীয়। দেশটির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই সাহারা মরুভূমি দ্বারা আবৃত। সামান্য কৃষির ওপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে সেখানে।

চাদের জনসংখ্যা এক কোটি ৮৬ লাখ ৩৩ হাজার ১৪০। উল্লেখযোগ্য তেলের রক্ষণাগার থাকা সত্ত্বেও দেশটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আছে উচ্চ মাত্রায় দারিদ্র্যের হার। বৃষ্টিনির্ভর কৃষির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল দেশটি। আবহাওয়া এক এক সময় এক এক রকম। এতে খাদ্য অনিরাপত্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমনপীড়নের অভিযোগ আছে।

লাইবেরিয়ার জনসংখ্যা ৫৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৮৬। জিডিপি ৪৫৯ কোটি ডলার। এখানে আছে গৃহযুদ্ধ। প্রাদুর্ভাব ঘটে ইবোলা ভাইরাসের মতো বিপর্যয়। আছে অস্থিতিশীল অবকাঠামো এবং সীমিত সেবা। বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ অন্য দেশে অভিবাসী হচ্ছেন। এতে কৃষি কাজে বিঘ্ন হচ্ছে। বাড়ছে খাদ্যে অনিরাপত্তা।

মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা দুই কোটি ৫৮ লাখ। জিডিপি ১৬৭৭ কোটি ডলার। আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে অবস্থান এই দ্বীপরাষ্ট্রের। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে। তারপর থেকে অনেক রাজনৈতিক সংকট এবং বহু সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে দেশটি। তুলনামূলক ভাল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বর্তমান সংবিধান প্রণীত হয় ২০১৪ সালে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেশটি সমৃদ্ধ। তবে আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, বাইরের হস্তক্ষেপ বিদ্যমান। জিডিপিতে বড় অবদান রাখে খনি এবং পর্যটন শিল্প।