রোজাদারের জন্য অফুরান পুরস্কার

রোজাদারের জন্য অফুরান পুরস্কার

রমজানুল মোবারকের আজ তৃতীয় দিন। রমজানের সিয়াম পালনের বিনিময়ে অফুরান পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ। বুখারি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বরাতে বর্ণিত আছে, রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় রমজানে। তবে সওম বা রোজা এ থেকে ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন, সওম আমারই জন্য এবং আমিই সেটার প্রতিদান দেব।

সে আমারই উদ্দেশে প্রবৃত্তি ও আহারের চাহিদা থেকে নিবৃত্ত থাকে। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (বুখারি ও মুসলিম)। ইহতিসাবের অর্থ আল্লাহর কাছে রোজার পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং সন্তুষ্টচিত্তে একনিষ্ঠভাবে সিয়াম পালন করা।

যে কোনো ইবাদত ও নেক আমল কবুল হওয়া এবং সওয়াবের উপযোগী হওয়ার জন্য ইমানদার হওয়া শর্ত। কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে বিভিন্ন নেক আমলের প্রতিদান প্রসঙ্গে ইমানের শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সূরা নাহলের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যে কেউ নেক আমল করবে, সে নর হোক কিংবা নারী হোক, যখন সে ইমানদার, তখন তাকে আমরা দান করব সুখময় জীবন এবং তাদেরকে দান করব তাদের কাজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

ইমানের আভিধানিক অর্থ যদিও বিশ্বাস, কিন্তু প্রকৃত ইমানের মর্ম অনেক ব্যাপক ও গভীর। বিশ্ব জগতের স ষ্টা ও নিয়ন্তা হিসাবে এক সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তেমনি এতটুকু জানা যথেষ্ট নয় যে, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরব মরুর এক জীর্ণ কুটিরে জন্ম নিয়ে মুহাম্মদ নামের এক মহাপুরুষ জগতবাসীকে শান্তি ও সম্প্রীতির পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিশ্বকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। এটুকু জানা ও এ জন্য তার প্রতি শ্রদ্ধাভাব পোষণ করাই যথেষ্ট নয়। কেননা এ ধরনের বিশ্বাস সমকালীন আরবের অনেকেরই ছিল। হিজরতের পর মদিনায় শেষ নবির প্রতি সবচেয়ে বিদ্বেষ পোষণ করত ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়।

অথচ তারাও শেষ নবিকে নিশ্চিতভাবে জানত। তাওরাত ও ইঞ্জিলে শেষ নবির যে বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, তা তাদের নখদর্পণে ছিল। প্রথম দর্শনেই তারা বুঝতে পেরেছিল উনিই সেই নবি, যার সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন আগের সব নবি ও রাসূল। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদেও বলা হয়েছে, তারা তাকে (শেষ নবিকে) চেনে যেমন চেনে নিজেদের সন্তানকে। এভাবে চিনতে পারার পরেও তারা মুমিন হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। কারণ ইমানের গভীর মর্মের মধ্যে নিহিত রয়েছে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মক্কার কুরাইশদের অভাব ছিল এ বিষয়টির বিষয়ে।

তারা জেনে বুঝেও আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শের কাছে নিজের সত্তাকে সমর্পণে প্রস্তুত ছিল না। কোনো ব্যক্তি যখন জগৎস ষ্টা ও নিয়ন্তা একক সত্তার প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেয় এবং তার বিধান ও নির্দেশের কাছে নিজের সব কিছু বিলীন করে দেওয়ার অঙ্গীকার করে, তেমনি তার প্রেরিত পুরুষ বা রাসূলের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনার শপথ করে, তখনই সে প্রকৃত মুমিন বলে সাব্যস্ত হয়।

মোটকথা রমজানের সিয়াম সাধনা থেকে পূর্ণ মাত্রায় লাভবান হতে হলে প্রয়োজন মহামহিম রাব্বুল আলামিনের প্রতি আনুগত্য ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার করা। নিজের চিন্তা, মনোভাব ও আচরণকে সাজাতে হয় মহান স্রষ্টার নির্দেশ ও কামনা অনুযায়ী। আর সে জন্য সহজ উপায় রাসূলে পাক (সা.) প্রদর্শিত রূপরেখা অনুসরণ। মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহবোধ থাকার পাশাপাশি তার আদর্শ ও পথ অনুসরণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞাও ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ।

আল্লাহর রাসূলকে যেমন জগৎবাসীর জন্য কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হয়, তেমনি আল্লাহর নির্দেশাবলি ও ব্যবস্থা সম্পর্কে তার বক্তব্যের প্রতিও আস্থা রাখতে হয়। পরকাল ও অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলে গেছেন, সেগুলোর সত্যতা সম্পর্কেও কোনো সন্দেহ পোষণ করা যায় না।

ইমানের গভীরতা ও দৃঢ়তা যার যত বেশি, যে কোনো নেক কাজে তার সওয়াবের পরিমাণও বেশি হবে। আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আধ্যাত্মিক বুজুর্গানে দীনের সঙ্গে সাধারণ মুমিনদের পার্থক্য এখানেই। আর এ কারণেই সবার মর্যাদা সমান নয়। তাই ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ মাহে রমজানের সিয়াম পালনের সার্থকতা ও সুফল প্রাপ্তির জন্য ইমানের পরিপক্বতা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজা পালনের নির্দেশ দানের সময় প্রথমেই বলেছেন, হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।

আল্লাহর কিতাব পাঠ, অধ্যয়ন ও চর্চা এবং রাসূলে পাকের হাদিস অধ্যয়ন, এ ব্যাপারে নিজের ইমানকে তাজা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ পবিত্র মাসে আল্লাহর বিশেষ হুকুম সিয়াম পালনের সঙ্গে সঙ্গে এ দিকটিও বিবেচনায় রাখা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি