কেমন হওয়া চাই আমাদের রমজান

কেমন হওয়া চাই আমাদের রমজান

রমজান একটি অসাধারণ কল্যাণের মাস। পুরো মাসেই রয়েছে রহমত, বরকত, ক্ষমা তথা মুক্তির মহান বার্তা। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবদ্দশায় যখন রমজানের আগমন হতো তখন তিনি অতিশয় আনন্দিত হতেন এবং সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমজান এসেছে’। (সুনানে নাসায়ি-২১০৬)

রমজান শব্দটি ‘রমজ’ থেকে এসেছে। ‘রমজ’ অর্থ প্রখর তাপ। রমজানকে রমজান এ জন্য বলা হয় যে, এ মাসে রোজাদার রোজা রেখে সব কিছু তার নফসে আম্মারা বা প্রলুব্ধকারী প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে করে থাকে। রোজাদার তার সামনে ভোগ সম্ভোগের সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের নফসকে সেগুলো থেকে বিরত রাখে। আগুন যেমন স্বর্ণকে নিখাদ করে দেয়; রোজা তেমনি ঈমানদারের ষড়রিপুর কামনা-বাসনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাকে খাঁটি বান্দায় পরিণত করে। আবার এরূপও বলা হয় যে, ‘রমজ’ অর্থ বর্ষাকালের বৃষ্টি। বর্ষাকালের বৃষ্টি যেমনি সমস্ত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে পবিত্র করে ফেলে তেমনি মাহে রমজান মানুষের শরীরের সমস্ত পাপ ধুয়ে পরিষ্কার করে অন্তরসমূহকে শুদ্ধ করে দেয়। (গুনিয়াতুত তালেবিন-৩৫২)

কুরআনের ভাষায় রোজাকে সিয়াম বা সাওম বলা হয়। সাওম অর্থ বিরত থাকা। সাওম পালনকারীকে ‘সায়েম’ বলা হয় এ জন্য যে, সে খাদ্য, পানীয় ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে। শুধু উপোস থাকার নাম রোজা নয়; বরং উপোস থাকার পাশাপাশি সব অন্যায় ও পাপ থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। অন্যায় ও পাপ পরিহার না করে শুধু উপোস থাকায় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সওয়াব পাওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ বর্জন করল না তার খাদ্য ও পানীয় বর্জন দ্বারা মহান আল্লাহর কিছ্ইু আসে যায় না।’ (সহিহ বুখারি-১৯০৩)

রমজান মাসের মর্যাদা আর গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখেই প্রশ্ন আসে এ মাসে আমরা কেমন কর্মতৎপর হবো? হ্যাঁ, এ মাস নিয়ে নবী করিম সা: কৃত আচরণই হবে আমাদের কর্মপরিকল্পনা। এ মাসের প্রধান লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন করা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারেরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা-১৮৩) সহজে বললে তাকওয়ার তিনটি স্তর- এক. সব ধরনের শিরক ও কুফুরি থেকে নিজেকে রক্ষা করা; দুই. সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং তিন. সব ধরনের সগিরা গুনাহ থেকেও নিজেকে রক্ষা করা। সবসময় মানুষের প্রথম কাজ হবে- আল্লাহ নিষেধ করেছেন এমন সব কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা এবং তাঁর আদেশসমূহ সামর্থ্যরে মধ্যে পালন করার চেষ্টা করা আর সেটি রমজান মাসেও।

রমজানে বর্জনীয় আমল
মিথ্যা কথা বলা : রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা রোজাকে ধ্বংস করে দেয়। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করে না, আল্লাহর কাছে তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি-৬০৫৭)

গিবত ও পরনিন্দা : গিবত, পরনিন্দা ও অপরের দোষচর্চা নিকৃষ্টতম অভ্যাস। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সূরা হুমাজাহ-০১) পবিত্র রমজান মাসে এই মহাব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

অনর্থক সময় নষ্ট করা : রমজান মাস ইবাদতের মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ মাসে যথাসাধ্য ইবাদত করা জরুরি। অনর্থক কথা বলে সময় নষ্ট করা মুমিনের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী কাজ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মুমিনের বৈশিষ্ট্য ব্যক্ত করে বলেন, ‘(সফলকাম হয়েছে সেসব মুমিন) যারা বেহুদা কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকে।’ (সূরা মুমিনুন-০৩)

হারাম খাওয়া : ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হলো, খাদ্য ও পানীয় হালাল হওয়া। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু থেকে খাদ্য গ্রহণ করুন এবং সৎকাজ করুন; নিশ্চয় আপনারা যা করেন সে সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবগত।’ (সূরা মুমিনুন- ৫১) এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টত বোঝা যায়, আগে হালাল খাবার খেতে বলেছেন তারপর নেক আমল করতে বলেছেন।

অশ্লীল বিষয় দেখা : আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক পাওয়া যাবে যারা রোজা রাখেন আবার পাশাপাশি আজেবাজে সিরিয়াল, নাটক, অসুস্থ ইউটিউব, গান-বাজনা ইত্যাদি নিয়েও মত্ত থাকেন। অথচ এর সবই ফাহেশা (অশ্লীল), অনর্থক ও নাজায়েজ কাজ। এগুলো রোজার অন্তর্নিহিত শক্তিকে নষ্ট করে দেয়। এ সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু তাকওয়ার খেলাফ কাজ করে তাকওয়া অর্জিত হয় না। রোজার উদ্দেশ্য নষ্ট হয়। আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে।’ (সহিহ বুখারি- ১৯০৪)

মালে ভেজাল দেয়া : খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভেজাল দেয়া ইসলামে হারাম। রোজা রাখার পাশাপাশি পণ্য ও খাদ্যে ভেজাল দিয়ে ব্যবসায় করলে সেই রোজা তার কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং সে শুধু উপোস থেকে কষ্টই করল।

ওজনে কম দেয়া : ব্যবসায়-বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিমাণ এবং ওজনে কমবেশি করা কিংবা ঠকানোর মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন একটি জঘন্য অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৩) রোজা রেখে ওজনে কম দিলে রোজা কবুল হবে কি না তা সব ব্যবসায়ীর ভেবে দেখা উচিত।

সেলফি ও আত্মপ্রদর্শন : অনেকে রমজান মাসে সাহরি ও ইফতারের সময় সেলফি ও আত্মপ্রদর্শন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অথচ সাহরি ও ইফতারের পূর্বমুহূর্ত দোয়া কবুলের সময়। প্রচারের জন্য ছবি তোলা একটি আমলে জুর বা মিথ্যা কাজ। সেলফি ও আত্মপ্রদর্শনের মাঝে রিয়াও রয়েছে যা আমলকে নষ্ট করে দেয়।

অশালীনভাবে চলাফেরা করা : রমজান ও রমজানের বাইরে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য। তবে রমজানে এ বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে চোখ ও লজ্জাস্থানের হিফাজত করা জরুরি। অযথা মার্কেটে ও শপিংমলে সময় ব্যয় করা অনুচিত।

অপচয় ও অপব্যয় : রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবিদের আদর্শ ছিল, তাঁরা খুবই হালকা খাবার দ্বারা ইফতার ও সাহরি করতেন। আনাস ইবনে মালেক রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: সালাতের আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যেত তবে শুকনো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ-২০০৯) সাহরির ব্যাপারে নবী করিম সা: বলেন, ‘মুমিনের উত্তম সাহরি হলো খেজুর।’ (সুনানে আবু দাউদ-১৯৯৮) ফলে রমজানে ইফতার ও সাহরিতে অপচয় ও অপব্যয়ের পর্যায়ে পড়ে এমন পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।

তাই আসুন, এই রমজানে নিজেকে বদলে নিই। নিজের জীবনের গুনাহগুলোকে নিজে নিজে চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে তওবা করি। বাকি জীবন সতর্কতার সাথে কাটাই। তাহলেই আমাদের জীবনে রমজান মাস আসা সার্থক হবে। আমরা নিজেরা উপকৃত হবো। দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।