একুশের চেতনা অনির্বাণ দীপশিখা

একুশের চেতনা অনির্বাণ দীপশিখা

একুশের চেতনাকে আমরা বুঝি তিনটি স্লোগান দিয়ে। একটা হল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, দ্বিতীয়টা ছিল- ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, তৃতীয়টা ছিল- ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’।

এ তিনটি স্লোগানের সঙ্গে পরে অন্য স্লোগান যুক্ত হয়েছিল। যেমন- ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। একুশের শহীদদের স্মরণে আমরা বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার তৈরি করলাম। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল যা। এ তিন-চার-পাঁচটি স্লোগানের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সর্বজনীন একুশের চেতনা।

একুশের চেতনা গড়ে উঠেছিল মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে। আমরা যদি বাইরের উদাহরণ নেই তাহলে দেখব যে, একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি হল মাতৃভাষা আর সেটাই পরে রাষ্ট্রের ভাষা এবং জীবিকার ভাষা হিসেবে বাস্তবায়িত হয়। আমাদের জাতিরাষ্ট্রে সেই ঘটনাগুলো ঘটেনি। শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে প্রথম প্রণীত সংবিধান, যেটি একটি সেক্যুলার সংবিধান, সেই সংবিধানে বলা হল- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে কাজের ভাষা হবে বাংলা কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কাগজে-কলমে সেটার উল্লেখ থাকলেও উচ্চশিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলার কোনো প্রতিষ্ঠা ঘটল না। উচ্চ আদালতে, উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের পূর্বতন শাসকদের ভাষা ইংরেজি ভাষা যেটাকে আমি রাজভাষা বলি সেই ইংরেজি ভাষা রাজভাষা হিসেবে যে পরিমাণ প্রাধান্য পেয়েছে তা দিন দিন ক্রমবর্ধমান রূপে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলা নামকাওয়াস্তে সংবিধানে উল্লিখিত রাষ্ট্রের ভাষা রয়ে গেল। কার্যক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা, উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসায় ইংরেজির বিস্তার ঘটল ভয়ানক রূপে। বর্তমানে শুধু রাজধানী ঢাকা নয় সুদূর গ্রামেও ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে ইংরেজি ভার্সন মাদ্রাসা। সেক্ষেত্রে একটি জাতিরাষ্ট্রের যে প্রাথমিক সংজ্ঞা- মাতৃভাষা হল রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্রভাষা জাতীয় ভাষা তথা জীবিকার ভাষা। সেই জীবিকার ভাষা বাংলা না-হওয়ার কারণ মাতৃভাষাকে আমাদের শিক্ষিত সমাজে অবহেলা-অবজ্ঞা। ফলে আমাদের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের জন্য বিদেশি রাজ ভাষা ইংরেজির প্রতিই ঝুঁকে পড়েছে। এ যেখানে বাস্তব পরিস্থিতি সেই ক্ষেত্রে একুশের চেতনা আর বেঁচে থাকে কিভাবে?

একুশের চেতনার মাধ্যমে এ দেশে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তারই ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু এ স্বাধীন বাংলাদেশের সুফল আত্মসাৎ করল এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা। স্বাধীন দেশে তারা ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো চেপে বসল।

আর্থ-সামাজিক ভাবে তারা বিদেশি শাসকদের শূন্য আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে একুশের চেতনার বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। রাতারাতি তারা ধনী অতি ধনী হয়ে উঠল- সমাজের বৈষম্য জারি রেখে তারা ক্রমাগত এ বৈষম্য বাড়িয়েই চলেছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় আমরা একথা বলতে পারি যে, বাঙালি ধনীক শ্রেণীর স্বার্থের যূপকাষ্ঠে একুশের চেতনাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু একুশের চেতনা বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের বীজমন্ত্র, এক অনির্বাণ দীপশিখা। সেটাতো নিভে যাওয়ার নয়, তাই আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে উত্থানের মধ্য দিয়ে সে এগিয়ে চলে। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

এমজে/