জাটকা রক্ষা করা গেলে ইলিশ যাবে হতদরিদ্রের ঘরেও

জাটকা রক্ষা করা গেলে ইলিশ যাবে হতদরিদ্রের ঘরেও

বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ ভাগই বাংলাদেশে হচ্ছে। চলতি বছর সাড়ে ৫ লাখ টন ইলিশ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। গত অর্থবছরে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার টন।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ইলিশ জাটকা ও রেণু রক্ষা-সংরক্ষণ করতে পারলে বিশ্বের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন হবে বাংলাদেশে। ফলে দেশের হতদরিদ্র মানুষের ঘরেও ইলিশ পৌঁছবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ শুধু প্রথমই থাকবে না, উৎপাদন দিন দিন আরও বাড়বে। জাটকা আহরণে বিরত অতিদরিদ্র জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ভিজিএফ খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান সরকার মৎস্য আহরণে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে।

মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ রাশেদুল হক জানান, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। জাটকা ও রেণু সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রতি বছরই আমরা এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত কর্মসূচি হাতে নিচ্ছি। এ ধারা অব্যাহত রেখে তা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশে পৌঁছানোর সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে জাটকা নিধন। চলতি অর্থবছর শেষে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন ইলিশ উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাটকা সংরক্ষণ ও রেণু রক্ষার মধ্য দিয়ে ইলিশ উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পযর্ন্ত জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০১৯ উদযাপন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়নে সময়োপযোগী এবং বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। শনিবার ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদ্বোধন করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা-উপজেলায় ৭ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। মতবিনিময় সভা, কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৬ ভাগ ইলিশের জোগান আসে বরিশাল থেকে। এরপর ইলিশের জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা। ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনা পানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে আসে। একটি ইলিশ ৩-২১ লাখ ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়।

বাংলাদেশ মৎস্য ইন্সটিটিউট পরিচালিত গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী গত বছর ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকরণের ফলে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি ডিম বেশি উৎপাদিত হয়েছে। এতে ৫০ ভাগ ডিমের সাফল্যজনক পরিস্ফুটন হলে ও ১০ ভাগ বেঁচে থাকলে ৩৫ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ উৎপাদন বেশি হয়েছে। এবারও জাটকা সংরক্ষণে যে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, তা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে ইলিশ উৎপাদন আরও ব্যাপক হারে বাড়বে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ উৎপাদনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ইলিশ উৎপাদন হয়। ইলিশ উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইলিশ উৎপাদন কমছে কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ছে।

ইন্সটিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৭-১৮ সালে তা ৫.১৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। পুষ্টিবিদদের বক্তব্য, ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড থাকে। ওই ফ্যাটি এসিডের প্রায় ২ শতাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা মানবদেহের কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ইলিশের আমিষে ৯ ধরনের অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ থাকে। এজন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাছ উৎপাদনে অগ্রগতির পেছনে মূল অবদান ইলিশের। উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের আট জেলায় ‘ইকো ফিশ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদফতর। এর আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো ইলিশের বংশবিস্তার ও প্রজননকাল নির্ধারণসহ নানা দিক নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে- বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। এতে মৎস্য অধিদফতরকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ’। মৎস্য বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে উপকূলের ইলিশ অতিমাত্রায় আহরণ থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং তা বড় হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।

এমজে/