ছোট্ট তুবা জানেই না মায়ের কী হয়েছে

ছোট্ট তুবা জানেই না মায়ের কী হয়েছে

‘মেয়ে আমার কিছুটা একরোখা ছিল, যা বলত তাই করত। চার বছরের তুবাকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে শুক্রবার রাতেই কথা বলছিল। তবে এখনই ভর্তি করতে নিষেধ করেছিলাম। শোনেনি। বলছিলÑ বাসায় থেকে দুষ্টুমি করবে, স্কুলে ভর্তি করলে শান্ত থাকবে।

শনিবার সকালে আমার কাছে তুবাকে দিয়ে ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে মা-মণি আমার বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। ফিরল লাশ হয়ে।’ গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকার বাসায় অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর মা সফুরা বেগম। কাঁদতে কাঁদতেই এ বৃদ্ধা বলেন, ‘শত শত মানুষ প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারল নিরপরাধ রেনুকে। এখন তুবার কী হবে, ওর ভাই মাহিরের কী হবে। তুবা এখনো জানে না ওর মা আর বেঁচে নেই। মায়ের মৃত্যুর খবর জানার পর মাহিরকেও সামলে রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু বিনাদোষে ছোট্ট দুই নাতি-নাতনিকে যারা মা-হারা করল তাদের তো কিছুই হলো না। মেয়ের হত্যাকারীদের কি বিচার পাব না আমরা?’

গত শনিবার সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজারের সামনে বাড্ডা প্রাইমারি স্কুলের গেটে ছেলেধরা সন্দেহে উচ্চশিক্ষিতা রেনুকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা। তাদের সন্দেহ ছিল, ওই নারী ছেলেধরা। পরে এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৪০০ থেকে ৫০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহতের ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু। এখন পর্যন্ত জাফর, শাহীন ও বাপ্পী নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নাসির উদ্দিন টিটু জানান, তাসলিমা বেগম রেনু লেখাপড়া শেষে আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেন। স্কুলেও করেছেন শিক্ষকতা। প্রায় ২ বছর আগে স্বামী তসলিম হোসাইনের সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এর পর থেকে মায়ের সঙ্গে মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটের একটি ভাড়া বাসায় ১১ বছরের ছেলে তাহসিন আল মাহির ও চার বছরের মেয়ে তাসনিম তুবাকে নিয়ে বসবাস করছিলেন রেনু। তবে ছেলেকে ছয় মাস আগে তার বাবা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা বড়ভাই মো. আজগার আলীর কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন রেনু।
টিটু আক্ষেপ করে বলেন, ‘ঘটনাস্থলের পাশেই স্থাপিত সিসি টিভি ক্যামেরায় দেখেছি, বাইরে থেকে হট্টগোল শুরু হয়েছে ছেলেধরা বলে। ৩ থেকে ৪ মিনিটের মধ্যেই স্কুলের কিছু অভিভাবক ও বাইরে থেকে আসা উচ্ছৃঙ্খল মানুষে ভরে যায় জায়গাটি। এর পর হাতে গোনা কয়েকজন যুবক মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে লাঠি দিয়ে পেটায় খালাকে। কেউ কেউ এলোপাতাড়ি লাথিও মারছিল। খালাকে কোনো কিছু বলার সুযোগই দেয়নি পাষ-রা। তখন শত শত মানুষ দর্শকের ভূমিকায় তা দেখছিল, কেউ আবার সেই মারধর মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিল। যেন কোনো এক তামাশা হচ্ছে সেখানে।’

একটু থেমে অশ্রুসিক্ত টিটু বলেন, ‘মানুষ মানুষকে শুধু সন্দেহের বশে হত্যা করে ফেলে! এ আমরা কোথায় আছি। কোন দেশে বাস করছি। শুধু একটা গুজব শুনেই নিরীহ এক নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বাস্তবতা পরখ করলাম না। অভিযুক্তের কোনো কথাই শুনলাম না।’ তিনি বলেন, ‘অদূরেই পুলিশ প্রশাসন থাকতে কীভাবে একজন নিরপরাধ মানুষকে খুন হতে হয়? এটা কোনো সভ্য সমাজের মানুষের কাজ হতে পারে না। যারা খালাকে মারছিল, যারা দাঁড়িয়ে দেখছিল, যারা ভিডিও করছিল; আমি মনে করি সবাই এ হত্যায় সমান অপরাধী।’

এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন গাজী বলেন, ‘ছেলেধরা গুজব থেকেই হত্যাকা-টি ঘটেছে বলে এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। ফুটেজ অনুযায়ী দায়ীদের শনাক্তেরও চেষ্টা চলছে। আমরা প্রধান শিক্ষকের স্টেটমেন্টও নিয়েছি। তদন্ত চলছে, তা শেষ হলেই মূল ঘটনা জানা যাবে। এ পর্যন্ত তিনজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যায় জড়িত বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল। আর গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’ তবে গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।

এমজে/