পরিবহনের অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে ঈদযাত্রাঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। শিডিউল বিপর্যয়, যানজট আর যাত্রা বাতিলের কবলে পড়ে ঈদযাত্রা। নৌ-পথে কিছুটা স্বস্তির যাত্রা নিশ্চিত হলেও সড়ক ও রেলপথে ছিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ট্রেনের দেখা পেতে কষ্ট হয়েছে। অগ্রিম টিকিট কেটেও ভ্রমণ করতে পারেননি অনেকেই। আর সড়কে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লগেছে ১০ ঘণ্টা। বন্যার কারণে সড়ক ও রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গুরোগও। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসবই হয়েছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও চরম অবহেলা আর অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রতি দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বন্যায় রেলওয়ের ৭টি রুট ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রেল সড়ক ভেঙে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। আবার কোথাও কোথাও মাটি ও পাথরসহ রেলপথ দেবে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ট্রেন আটকা পড়েছে। এ কারণে রেল চলাচলে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে রুট পরিবর্তন করে চলাচল করতে হয়েছে। এর দুই সপ্তাহের মধ্যে কোরবানির ঈদ হওয়ায় ঈদযাত্রার আগে ক্ষতিগ্রস্ত সেসব লাইন পুরোপুরি মেরামত করা সম্ভবই হয়নি। এর মধ্যে গত শুক্রবার টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় সঙ্কট আরও চরমে ওঠে। এ ঘটনায় ওইদিন উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলগামী সব ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এর প্রভাব পড়েছে ঈদযাত্রার প্রতিটি ট্রেনের ওপর। ফলে ট্রেনের নিয়মিত শিডিউলে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে এই আশঙ্কার কথা জানা থাকলেও রেল কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানতে চাইলে রেল সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বন্যার কারণে এবছর আমাদের রেলপথের কিছু সমস্যা হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে দুর্ঘটনার কারণে এই চিত্র আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তাছাড়া ঈদ মৌসুমে প্রতিটি স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য দুই মিনিটের বদলে ৫ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সে কারণে শিডিউল সমস্যা আরও বেড়েছে।
অনেক জায়গায় ঈদযাত্রা ব্যাহত হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের কারণেঈদযাত্রার সড়কপথের অবস্থাও প্রায় একই। বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে এই ক্ষতি হয়েছে দেশের পুরো উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের কেন্দ্রীয় বন্যা তথ্যকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, সম্প্রতি সংঘটিত বন্যায় দেশের ২১ জেলায় ৬৩৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জেলা সড়ক আছে ১২০ কিলোমিটার। আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫২ কিলোমিটার। এর বাইরে ৪০৫ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে বেশি সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের পরিমাণ ১৮৫ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩৪ কিলোমিটার জাতীয় ও ১৫২ কিলোমিটার জেলা সড়ক।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, ঈদের অন্তত সাতদিন আগেই বন্যা-বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক মেরামত সম্পন্নের। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মেরামত কাজ ঈদের তিনদিন আগে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, নির্ধারিত সময়ের আগে এই সড়কগুলো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এ বছর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ পথের যাত্রীদেরকে দুর্ভোগ আরও বেশি হয়েছে বলে মনে করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তাছাড়া এবছর এডিস মশার প্রাদুর্ভাবের কারণে দায়িত্বশীল সকলের চোখ ছিল ডেঙ্গু রোগ ও এ রোগের বাহক এডিস মশার ওপর। তারা সবাই ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরমুখো মানুষের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
যানজট আর ধীরগতিতে গাড়ি চলার কারণেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদেরতবে সড়ক পথের এই দুর্ভোগকে তেমন আমলে না নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ঈদযাত্রার দুর্ভোগকে দুর্ভোগ হিসেবে মনে করে না। এটা তারা ঈদ আনন্দের অংশ হিসেবে মনে করে। তবে, কিছুটা দুর্ভোগ যে নেই সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’ গত শনিবার রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনের সময় তিনি এ কথা বলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঈদের আগেরদিন রবিবার (১১ আগস্ট) সায়েদাবাদ টার্মিনালের জনপথ মোড়ে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার বিষয়টি পরিদর্শনকালে তিনি ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির দায় স্বীকার করেন এবং এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী হিসেবে এর দায় এড়ানো যায় না।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের মতে এবছর বন্যার কারণে রেল ও সড়ক পথের কিছু ক্ষতি হয়েছে। যদি পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হতো তাহলে সেই ক্ষতি পূরণ করে যাত্রাপথ নিশ্চিত করা যেতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে এটা সম্ভব হয়নি। এই সমস্যায় পড়বেন এমন আশঙ্কা তাদের জানা থাকলেও সঠিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেননি। যে কারণে ঘরমুখো মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগের চার দিনে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ ঢাকা ত্যাগ করেন। এই মানুষগুলোকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের হয়নি। এই সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। তাছাড়া এবছর সড়কপথ নিয়ে তেমন কর্মপরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি।’ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া গণপরিবহন নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এ বছর সড়ক পথে দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে সড়কে হাট বসানো। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এজন্য কোনও ব্যবস্থাপনাও ছিল না। ট্রাফিক পুলিশ কোথাও বাধা দেয়নি। যে কারণে যানবাহন চলাচলে চরম বিঘ্ন ঘটেছে। ঈদের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সামগ্রিক পরিকল্পনা না থাকায় এই দুর্ভোগে সবাইকে পড়তে হয়েছে। তাছাড়া সবই ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর তেমন নজর দেয়নি।
এদিকে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম সড়ক, রেল ও নৌ পথের মধ্যে এ বছর লঞ্চযাত্রা ঘরমুখো মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। ঈদের আগের দুই দিন সদর ঘাট থেকে দুই শতাধিক লঞ্চ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেলেও নৌপথ ব্যবহারকারী যাত্রীরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, সুষ্ঠু ও নিরাপদভাবে ঈদযাত্রা সম্পন্ন করার জন্য অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি। আমাদের সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত যাত্রী ছিল আমরা লঞ্চের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিদিন প্রায় দুইশ’ এর বেশি লঞ্চ চলাচল করেছে। আর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কোনও সমস্যা হয়নি।