সরকারি হাসপাতালে কেনাকাটায় হরিলুট, অভিযুক্ত সব প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত

সরকারি হাসপাতালে কেনাকাটায় হরিলুট, অভিযুক্ত সব প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত

সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারি হাসপাতালের অসাধু পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি চক্র এ দুর্নীতির মূল কারিগর।

তারা কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে। হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি না কিনেই ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা তুলে নিচ্ছে।

এক টাকার পণ্য কিনে ১৫০ টাকা বিল, প্রয়োজন ছাড়াই মেডিকেল সরঞ্জাম কেনা, পণ্য সরবরাহ না করে বিল নেয়াসহ নিত্যনতুন কৌশলে অর্থ লোপাট করছে চক্রটি। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এসব হচ্ছে মূলত তাদের নামই তালিকায় আসছে।

প্রথম ধাপে সরকারি অর্থ তছরুপসহ দুর্নীতির মামলা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় রাখা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে বা মামলা প্রক্রিয়াধীন পর্যায়ক্রমে তাদেরও আনা হবে এ তালিকায় ।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটির বিশেষ অনুসন্ধান শাখার পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্ত চলছে।

বিশেষ সেল থেকে কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে কমিশনকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষ সেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সিপিটিওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন।

সিপিটিও থেকে জানানো হয়েছে, কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা বা দুর্নীতির মামলা হলে তার দায়দায়িত্ব ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়।

এক্ষেত্রে দুদকের পক্ষ থেকে সেইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ছাড়াও যে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। এরপর থেকেই কাজ শুরু করে সংস্থাটি।

সূত্র জানায়, গত এক অর্থবছরেই কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য অন্তত ২৯১ কোটি টাকার কেনাকাটা ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়।

অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে।

এ অর্থের কত ভাগ দুর্নীতিবাজদের পেটে গেছে, সেই হিসাব বের করছেন দুদক কর্মকর্তারা। এসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজে যেসব ঠিকাদার জড়িত ছিলেন তাদের সবার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে দুদক টিম।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরে যেসব ঠিকাদার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কাজ পেয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করছে।

এরই মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানগুলো মামলায় জড়িয়েছে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে দুদক থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চিঠি দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।

তালিকায় প্রথম দফায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো হল- স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজালের স্ত্রী রুবিনার নামে করা রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও রূপা ফ্যাশনস লিমিটেড।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের জন্য কেনাকাটা ও ভুয়া যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে আবজাল সিন্ডিকেট ৪৮ কোটি টাকার কাজে ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে লুটে নেয়।

দুদকের মামলায় যাকে ‘আত্মসাৎ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ৭টি প্যাকেজে কেনাকাটায় পুরোটাই হয়েছে দুর্নীতি। এ কলেজে ১০ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বিল করা হয়েছে।

৪৮ কোটি টাকার সব বিলই এভাবে করা হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সুবাস চন্দ্র সাহা, সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, কলেজের হিসাবরক্ষক হুররমা আক্তার খুকী, কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া, একই দফতরের সাবেক এসএএস সুপার সুরজিত রায় দাশ, পংকজ কুমার বৈদ্য এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক উচ্চমান সহকারী খায়রুল আলম ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন।

সে কারণে এরা সবাই দুদকের অভিযোগের তালিকায় আছেন। আবজালের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে আলাদা মামলাও হয়েছে। মামলায় ৩২১ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে আবজাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। এতে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়।

তদন্তে এ দুর্নীতির অঙ্ক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দুদক সূত্রে ধারণা পাওয়া গেছে। আবজাল ও তার স্ত্রী বর্তমানে কানাডায় পলাতক। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন ও মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার করে তারা বিপুল সম্পদ গড়েছেন ওইসব দেশে। কালো তালিকায় এ দুটি প্রতিষ্ঠান সবার আগে।

তালিকায় আছে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ও আহমেদ এন্টারপ্রাইজ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটরের নাম আবদুল্লাহ আল মামুন ও মুন্সী ফররুখ হোসাইন। মিরপুর ১২ এর ব্লক-বি, রোড-৩ ও বাড়ি-৪৪/এ ঠিকানা ব্যবহার করে এ প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নেয়া হয়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং প্রাক্কলন ছাড়া উচ্চমূল্যে পর্দা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে ওই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

মামলায় অনিয়মে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গণপতি ও ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে।

রংপুরের হাজীপাড়া ধাপের বাসিন্দা মনজুর আহমেদের মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড এসকে ট্রেডার্স, মো. মন্টুর মেসার্স এসএম ট্রেডার্স, মোসাদ্দেক হোসেনের এমএইচ ফার্মা, জয়নাল আবেদীনের মেসার্স অভি ড্রাগস ও আলমগীর হোসেনের মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি নামীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণা করে সরকারের ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়।

৩৭/২ পুরানা পল্টনের আবদুস সাত্তার সরকারের মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও ৫/বি তোপখানা রোডের আসাদুর রহমানের ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশন ও একই ঠিকানায় করা জাহেদ উদ্দিন সরকারের মেসার্স বেঙ্গল সায়িন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোংয়ের বিরুদ্ধে এক মামলায় ৬ কোটি ৬ লাখ টাকার দুর্নীতির মামলা হয়েছে। এছাড়া মেসার্স বেঙ্গল সায়িন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোংয়ের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা হয়েছে। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ৫৬১ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা হয়েছে।

এর বাইরে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খুলনা ও সাতক্ষীরায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা আছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ৬৫ কোটি টাকার কেনাকাটা ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এতে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

দুদকের উপ-পরিচালক সামসুল আলম জানান, এ হাসপাতালে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে এর পরিচালক ও ঠিকাদারসহ অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

৫ হাজার সাবান একদিনে কেনা হল কেন- এর কোনো সদুত্তর নেই। এছাড়া গাজীপুর মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও সিভিল সার্জন, কুড়িগ্রাম হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া ও মালামাল সরবরাহে অনিয়মে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এমজে/