ঢাকা সিটিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, রাত পোহালেই ভোট

ঢাকা সিটিতে  সব প্রস্তুতি সম্পন্ন,  রাত পোহালেই ভোট

প্রচার-প্রচারণা শেষ। টানটান, উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার মধ্যে আগামীকাল শনিবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। এ জন্য শনিবার সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নির্বাচনী এলাকায় সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ দিনের উৎসবের আমেজে প্রচার-প্রচারণার মাঝে ছিল অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ নিয়ে আপত্তি ও সমালোচনা। দুই সিটিতেই নির্বাচনী প্রচারণায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই এই ভোটযুদ্ধ। ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপির) ধানের শীষ প্রতীকের তাবিথ আউয়াল এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপির) ধানের শীষ প্রতীকের ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের মধ্যেই মূলত লড়াই হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ঢাকার এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছেন। নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণে ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারও একটা স্নায়ুচাপের মধ্যে আছে।

এবারই প্রথম ঢাকার দুই সিটির সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। এই ইভিএম পরিচালনায় কারিগরি সহায়তা দেবেন সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচ হাজারের বেশি নিরস্ত্র সদস্য; যারা দায়িত্ব পালন করবেন সব ভোটকেন্দ্রে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০ এ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য ভোটকেন্দ্র হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করা হয়েছে তারা বিদ্যমান সিসি ক্যামেরা মক ভোটিংয়ের দিন, নির্বাচনের আগের দিন এবং নির্বাচনের দিন ব্যবহার করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তবে শর্ত থাকে যে, ভোট গ্রহণের দিন গোপন কক্ষের কোনো দৃশ্য সিসি ক্যামেরার আওতায় আসবে না। ইসির নির্দেশনায় আরো বলা হয়, ভোটকেন্দ্রে বিদ্যমান সিসি ক্যামেরার সংখ্যাসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে বিদ্যমান সিসি ক্যামেরা মক ভোটিংয়ের দিন, নির্বাচনের আগের দিন এবং নির্বাচনের দিন ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে সার্বিক সমন্বয় ও সহায়তার জন্য ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি : এই সিটিতে মেয়রপ্রার্থীরা হলেন, আওয়ামী লীগের মো: আতিকুল ইসলাম, বিএনপির তাবিথ আউয়াল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শেখ মো: ফজলে বারী মাসউদ, পিডিপির শাহীন খান, এনপিপির মো: আনিসুর রহমান দেওয়ান ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আহম্মেদ সাজ্জাদুল হক। এই সিটিতে মেয়র পদে ছয়জন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ২৫১ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৭৭ জনসহ তিন পদে ৩৩৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড সংখ্যা ১৮টি, ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৩১৮টি, ভোট কক্ষের সংখ্যা সাত হাজার ৮৪৬টি। আর অস্থায়ী ভোটকেন্দ্র না থাকলেও অস্থায়ী ভোট কক্ষের সংখ্যা ৭৫৪টি। এই সিটিতে ভোটার ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ জন এবং নারী ভোটার ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি : এই সিটিতে মেয়রপ্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, জাতীয় পার্টির হাজী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, ইসলামী আন্দোলনের মো: আবদুর রহমান, এনপিপির বাহরানে সুলতান বাহার, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো: আকতার উজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লা ও গণফ্রন্টের আব্দুস সামাদ সুজন। এই সিটিতে মেয়র পদে সাতজন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৩৩৫ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৮২ জনসহ তিন পদে ৪২৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা ৭৫টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড সংখ্যা ২৫টি, ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ১৫০টি, ভোট কক্ষের সংখ্যা ছয় হাজার ৫৮৮টি। অস্থায়ী ভোটকেন্দ্র না থাকলেও অস্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৮৭৬টি। এই সিটিতে ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন। তার মধ্যে পুরুষ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ জন এবং নারী ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন।

ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র : আসন্ন নির্বাচনে দুই সিটিতে ৬৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। দুই হাজার ৪৮৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে এক হাজার ৫৯৭টি ভোটকেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইসির ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৮৭৬টি, দক্ষিণে ৭২১টি। বাকি ৮৯১টি সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে গণ্য। কাফরুল, তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুর থানার সবগুলো ভোটকেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

যান চলাচল : ৩০ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে এ সময় সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের কোনো বাধা নেই বলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নির্দেশনায় জানিয়েছেন ইসি। এ ছাড়া ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার মধ্য রাত থেকে আগামী শনিবার সন্ধ্যা ৬ পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : ৩০ জানুয়ারি থেকে চার দিনের জন্য রাজধানীতে ৬৫ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। দুই সিটিতে আরো পাঁচ প্লাটুন করে মোট ১০ প্ল্যাটুন বিজিবি সদস্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকবে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি দুই সিটি নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭ প্লাটুন ও দক্ষিণ সিটিতে ৩৮ প্লাটুন বিজিবি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৪ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭৬ জনসহ ১৩০ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। আর এ ক্ষেত্রে বিজিবির এক প্লাটুন সদস্য নিয়ে দুটি টিম গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। প্রতিটি টিমের নেতৃত্ব দেবেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তবে আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা পাঁচ দিনের জন্য নিয়োজিত থাকবেন।

দুই সিটির ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার স্বার্থে উত্তর সিটির ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডে পুলিশ ও এপিবিএন সমন্বয়ে ৫৪টি মোবাইল টিম ও ১৮টি স্ট্রাইকিং ফোর্স, র্যাবের ৫৪টি মোবাইল টিম এবং ২৭ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন থাকবেন।

অন্য দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে পুলিশ ও এপিবিএন সমন্বয়ে ৭৫টি মোবাইল টিম ও ২৫টি স্ট্রাইকিং ফোর্স, র্যাবের ৭৫টি মোবাইল টিম এবং ৩৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়াও নির্বাচনী এলাকায় ভোটের দুই দিন আগ থেকে ভোটের দিন এবং ভোটের পরের দিনসহ মোট চার দিন এবং আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা মোট পাঁচ দিন নির্বাচনী এলাকায় মোতায়েন থাকবেন। ভোটের আগের দিন রাত থেকে প্রত্যেক কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন্দ্রে অবস্থান করবে।

বিচারিক কর্মকর্তা : দুই সিটিতে ১২৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৬৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো অপরাধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনে সাজা দিবেন। এ ছাড়া উত্তর সিটিতে ৫৪ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ৭৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৩০ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠে রয়েছেন। তারা নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবেন।

ইভিএমের জন্য সেনা : ইভিএম পরিচালনায় দায়িত্বরত নিরস্ত্র সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনী সব পদক্ষেপ নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সেনাক্যাম্প স্থাপন অথবা প্রশাসনিক সুবিধাদানকারী ডিভিশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। ইভিএম-বিষয়ক এক বিশেষ পরিপত্র জারি করে এমন নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

ইসির উপ-সচিব আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত পরিপত্রের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ভোট গ্রহণের দিন কেন্দ্রে কারিগরি সহায়তা দেয়া সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র থাকবেন। রিটার্নিং অফিসার/সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং ক্ষেত্রমতে প্রিজাইডিং অফিসার, ভোটকেন্দ্রে অবস্থানকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও টহল কাজে নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সহায়তায় ওই সশস্ত্রবাহিনীর কারিগরি সদস্যদের যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সশস্ত্রবাহিনীর কারিগরি সদস্যরা মোবাইল ফোন বহন করতে পারবেন। উল্লিখিত ব্যবস্থা ছাড়াও যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিরোধ এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা সবশেষ পন্থা হিসেবে সেনাক্যাম্প স্থাপন করে অথবা প্রশাসনিক সুবিধাদানকারী ডিভিশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

এমজে/