ভোটবিমুখ ভোটার দুশ্চিন্তা সবার

ভোটবিমুখ ভোটার দুশ্চিন্তা সবার দুই সিটি করপোরেশনে ভোটের দিন এমনই অলস সময় কাটিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কম ভোটের নির্বাচন হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি-ডিএসসিসি)। গত ১ ফেব্রুয়ারির এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির উদ্বেগজনক হার ভাবিয়ে তুলেছে পর্যবেক্ষদের। নজিরবিহীন কম ভোট পড়ার বিষয়টি এখন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক সবার মুখে মুখে। বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব পর্যায়ও ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে দুর্ভাবনা ঢাকতে পারছে না।

যদিও এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রচলন ঘটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতিকে দোষারোপ করছে। তারা বলছে, রাজনৈতিক মাঠের পাশাপাশি ভোটের মাঠেও কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ‘ফল আঁচ’ করতে পেরে মানুষ ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছে। তবে আশঙ্কাজনক এ কম ভোটের হার গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য স্বস্তির কি-না, সে প্রশ্ন উঠেছে জোরেশোরে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন। অথচ মোট ভোট পড়েছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। ডিএনসিসিতে মোট ভোটার ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। ভোট দিয়েছেন সাত লাখ ৬২ হাজার ১৮৮ জন। অর্থাৎ ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি। ডিএসসিসিতে মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ জন। ভোট দিয়েছেন সাত লাখ ১৩ হাজার ৫০ জন। অর্থাৎ ভোট পড়েছে ২৯ শতাংশ। আর ৭১ শতাংশ মানুষই ভোট দেননি। হিসাবে এটা একেবারেই স্পষ্ট যে, সবমিলিয়ে এক-তৃতীয়াংশ মানুষও ভোট দিতে যাননি।

ডিএনসিসিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মোট ভোটারের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন পেয়ে জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে ডিএসসিসিতে একই পদে দলটির প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মোট ভোটারের মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের ভোটে জয়ী হয়েছেন। ভোটের হারের হিসাবে স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটাররাও এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি।

দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ হলেও এমন ভোটখরা কখনও দেখা যায়নি, কেবল গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম–৮ সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন ছাড়া (ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২৩ শতাংশ)।

২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নানা অভিযোগ থাকলেও ওই নির্বাচনেও দলটি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪৮ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এমনকি গত বছরের মার্চে ডিএনসিসিতে মেয়র পদে যে উপ-নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াও ভোট পড়ে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তার আগে ২০১৫ সালে ডিএনসিসি নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ডিএসসিসিতে ভোটের হার ছিল ৪৮ শতাংশ।

সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। কারণ, সেখানে কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু এবার শুধু বিএনপি বা অন্য দলের নেতা-কর্মী নন, আওয়ামী লীগের ভোটারদেরও কেন্দ্রে নিতে পারেননি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা।

দুই সিটি করপোরেশনে ভোটের দিন এমনই ফাঁকা ছিল অনেক ভোটকেন্দ্র
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, কয়েক বছর ধরে নির্বাচনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে ভোটাররা ভোটবিমুখ হচ্ছেন। ভয়-ভীতিসহ নানা কারণে কেবল বিরোধী দলের ভোটাররাই নন, সরকারি দলের ভোটাররাও ভোট দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না।

নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার নিয়ে চিন্তিত হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এজন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনকেন্দ্রিক আতঙ্কজনক বক্তব্য-প্রচারণাকে দায়ী করছেন।

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভোটের রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। আমাদের আওয়ামী লীগের এত জনসমর্থন, সেখানে আরও বেশি ভোট আশা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের যে পার্সেন্টেজ সেই তুলনায় তো উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। তবে একটা বিষয় হচ্ছে। এই যে ভোটের আগেভাগেই শঙ্কা তৈরি করা- এই সিস্টেম খারাপ, এই সিস্টেমে ভোট দেয়া যাবে না। এই রকম অবস্থায় কিছু মানুষের আগ্রহ তো কমতেই পারে। কারণ ভোট সম্পর্কে অপপ্রচারটা অনেক বেশি হয়েছে। সরকারি দলের ভয়ঙ্কর প্রস্তুতি, বিরোধী দলও সতর্ক পাহারায় থাকবে, তারা ঢাকার বাইরে থেকে লোক জড়ো করেছে- এ ধরনের ইনফরমেশন তো ছিলই। আমার মনে হয়, সবকিছু মিলিয়ে একটা ভালো ইলেকশন হয়েছে।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বাইর থেকে ৪০ হাজার সন্ত্রাসী এনে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবে বলে বিএনপি যে উস্কানিমূলক কথা বলেছে, তাতে সাধারণ ভোটাররা ভয় পেয়েছেন। সেজন্য ভোটার হার কম হয়ে থাকতে পারে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘ভোটের বিষয়ে বিএনপি আগে থেকেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তারা নিজেরাও ভোট দিতে আসেনি। আবার অন্যদেরও আসতে দেয়নি। বাইরের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবে বলে বিএনপির অপপ্রচারের কারণে ভোটার কম এসেছে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মনে করেন, ‘ভোট কম পড়েছে, এটা ঠিক। তবে এর পেছনে কারণ আছে। প্রথমত, পূজাসহ টানা তিনদিন ছুটি থাকায় অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, শুরু থেকেই ইভিএম নিয়ে বিএনপির নেতিবাচক প্রচারণা মানুষের মধ্যে এনিয়ে একটি সংশয় তৈরি করে। তৃতীয়ত, বিএনপি বলছে তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটে এসেছে, জেতার জন্য নয়। এসব কারণে প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘মূলত কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের কর্মীরা ভোটার আনেন। তারা সেই কাজ পুরোপুরি করতে পারেননি। তাছাড়া রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়া, কেন্দ্রের বাইরে লোক রাখাসহ বিভিন্ন কথা বলেছেন। এতে এক ধরনের ভীতি ভোটারদের মধ্যে ছিল।’

এক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন পর্যবেক্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদারের। তিনি মনে করেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে যে নির্বাচনী সংস্কৃতি চলছে, সে কারণে ভোটের প্রতি মানুষের উৎসাহ কমে গেছে। আরেকটি কারণ হতে পারে, জাতীয় নির্বাচনকে মানুষ যত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, এ নির্বাচনকে তারা সেভাবে নিতে পারেনি।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব ভোটার হার কমে যাওয়ার জন্য সরাসরি সরকারকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘ভোটে জনগণের অনীহায় বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশিত হয়েছে। আগের রাতে ভোট ১০০ ভাগ কাস্টিং হওয়ার রেকর্ডের কারণে সরকারের ওপর জনগণের আস্থার বিলোপ ঘটেছে।’

গতকাল সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বাম গণতান্ত্রিক জোটের সভার প্রস্তাবে বলা হয়, দুই সিটির নির্বাচনে শতকরা ৯০ ভাগ ঢাকাবাসী ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে বর্তমান সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ করেছে। বিগত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় ২৯ তারিখ রাতে ডাকাতি করে ভোটাধিকার হরণের যে নজির সরকার গড়েছে, তাতে জনগণ মনে করে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। তারই প্রমাণ হলো ঢাকা সিটি নির্বাচন।’

তবে গণতন্ত্রের স্বার্থেই এ অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সব দলের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন- বলেন পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী? এ প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রহীনতার নামান্তর। এ নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অনীহা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, জাতি কি ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ভোটকেন্দ্রে বিরোধীপক্ষের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। জনগণ ভোটের প্রতি নিরাসক্ত হলে নানা প্রকার ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা দিয়ে এ বাস্তব অবস্থার চিত্রটি খণ্ডন করা যাবে না। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে সকল রাজনৈতিক দল আলোচনার টেবিলেই নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে। তা না হলে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ।’