করোনাভাইরাস গুজবের জেরেই কি প্রাণ হারালেন সাতক্ষীরার নারী?

করোনাভাইরাস গুজবের জেরেই কি প্রাণ হারালেন সাতক্ষীরার নারী?

‘তোমার ছেলের করোনাভাইরাস হয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। হাসপাতালের লোকজন তাকে খুঁজছে’, সোমবার এলাকাবাসীর এমন নানা কথাবার্তায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন রেণুকা বালা। ওই রাতেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান তিনি।

ঘটনাটি ঘটেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি গ্রামে।
অবশ্য এই ছেলের বিপদ নিয়ে উদ্বেগই রেনুকা বালার হার্ট অ্যাটাকের কারণ কি না, সেটা স্পষ্ট হয়নি চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে। তবে এই ঘটনাটি ওই এলাকায় দারুণ আলোড়ণ সৃষ্টি করেছে।

যাকে নিয়ে আলোচনা, সেই রেণুকা রপ্তানের ছেলে রতন রপ্তানের সাথে কথা হয়েছে বিবিসির। তিনি জানান, তিনি গত সোমবার ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরেন। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে পৌঁছালে সবার মতো তারও স্ক্রিনিং করা হয়।
এ সময় তার শরীরে জ্বর সেইসঙ্গে সর্দি-কাশি ধরা পড়ে। পরে ইমিগ্রেশনের চেকআপ ইউনিটের কর্মকর্তারা তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। সেখানকার চিকিৎসকরা তার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। কিন্তু তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়নি।

তবে তার লক্ষ্মণগুলো করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলোর সঙ্গে মিলে যাওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে সামনের কয়েকদিন বাড়িতে আলাদা হয়ে থাকার এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে চলার পরামর্শ দেন।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারমান আতাউর রহমান বলেন, রতন রপ্তানের এই ঘটনাটি এক কান দুকান হয়ে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এর মধ্যেই নানা গুজব ডালপালা মেলেছিল।

কারা এই গুজব ছড়িয়েছে তা স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও মি. রহমান বলেন, অনেকে রতন রপ্তানের মায়ের কাছে এসে এমন কথাও বলছিল যে ‘রতন সাতক্ষীরা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন বলে পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে’। এরই মধ্যে গুজবটি আরো শক্ত ভিত্তি পায় যখন শ্যামনগরের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা রতন রপ্তানের স্বাস্থের খোঁজখবর নিতে চেয়ারম্যান আতাউর রহমানকে ফোন করেন।

রতন রপ্তান বলছেন, সারাদিনের এসব ঘটনাপ্রবাহ ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল তার মাকে। রাত থেকে তার বুকে ব্যথা হতে শুরু করে। পরে সোমবার রাত ১১টার দিকে তাকে শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রতন রপ্তান বলেন, ‘আমার রক্ত নিয়ার পর যখন রিপোর্ট নিতি যাবো। আমাকে ভেতরেই ঢুকতে দেয়নি। এখন এতো ব্যাগ নিয়ে কতোক্ষণ দাঁড়ানো যায়। পরে আমি রিপোর্ট ছাড়াই বাড়ি ফিরলাম। দেখি যে আমার মা একবার ঘরের ভেতরে ঢুকছে আর বাইরে বেরুচ্ছে।’ ‘শুনি যে মানুষ ওসব কথা বলছে যে আমারে নাকি ভাইরাসে ধরিছে। পুলিশ পেলে ডাক্তার পেলে মেরি ফেলবে। মায়ের টেনশন হচ্ছিল স্বাভাবিক’।

রতন রপ্তান জানাচ্ছেন তিনি এখন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন যেখানে বলা হয়েছে তার শরীরে করোনাভাইরাসের কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেটা ‘কেউ বিশ্বাস করছে না। কেউ আমাদের বাড়ির আশেপাশে আসছে না।’

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হোসেন সাফায়েত বলছেন, ‘রেণুকা বালা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। এখন তার ওই আতঙ্কের কারণেই কি তিনি মারা গেছেন কিনা এটা তো বলা সম্ভব না।’

তিনি জানান, ইমিগ্রেশনে রতন রপ্তানের সর্দি-জ্বর ধরা পড়ায় তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। ‘আমরা পরে তার খোঁজ নিতে ফোন দিয়েছি। কিন্তু খবরগুলো এভাবে মানুষ ছড়াবে কেউ ভাবতেও পারিনি।’ বলেন মি. সাফায়েত।

গুজব ছড়ালে শাস্তি
করোনভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে অনেকেই জেনে - না জেনে, বুঝে - না বুঝে গুজব ছড়াচ্ছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং অনলাইনে অনেক গুজব ডালপালা মেলছে। এই ব্যাপারটি পুলিশের নজরেও রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন এবং তারা গুজব প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

করোনাভাইরাস: লক্ষণ ও বাঁচার উপায় কী?
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের সহকারী উপ কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলছেন যারা এ ধরণের গুজব ছড়াবেন তাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নেয়া হবে।

ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘এ ধরনের প্রোপাগাণ্ডা থেকে দুরে থাকুন আর এই ভাইরাসের ধ্বংস কামনা করুন’।

‘আতঙ্ক ছড়াবেন না’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং এতে কয়েকশ মানুষের প্রাণহানির খবরের পর ছোঁয়াচে এই রোগটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যার সবশেষ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, রবিবার রংপুরে চীনফেরত এক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর চাঞ্চল্য শুরু হওয়ার খবরের কথা।

যদিও শিক্ষার্থীটির শরীরে করোনাভাইরাসের কোন উপসর্গ ছিল না, তারপরও তাকে করোনা ইউনিটে নিয়ে আলাদা করে রাখার পর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বা আইইডিসিআর- এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা মনে করছেন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, এবং সেটাকে তিনি অধিক মাত্রায় প্রচার প্রচারণা সচেতন করার চেষ্টার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন।
কোয়ারেন্টিন কী, কেন, কীভাবে করা হয়?

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের প্রচার-প্রচারণা মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি, মানুষের মনের মধ্যে একটুখানি আতঙ্কও সৃষ্টি করে ফেলেছে।’ আবার মানুষ সঠিকভাবে সচেতন হচ্ছে কি না কিংবা আতঙ্কিত হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘অহেতুক আতঙ্ক ছড়াবেন না’।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশেও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি বন্দর, বিমানবন্দর, এবং স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে
সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সাতক্ষীরা ভোমরা স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশনে মেডিকেল টিম কাজ করছিল।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্ক্রিনিং এর সময় কারও শরীরে তাপমাত্রা বেশি ধরা পড়লে অর্থাৎ জ্বর,সর্দি, কাশি দেখা দিলে, যেগুলো কিনা করোনাভাইরাসের লক্ষণ, তাদের নাম পরিচয় লিপিবদ্ধ করে যেন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জেলা সদর হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।

আইইডিসিআর এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে যদি কেউ চীন থেকে ফেরত আসেন অথবা উপদ্রুত এলাকার কোন মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলেই তাদেরকে হাসপাতালের নিদিষ্ট স্থানে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা হবে। সূত্র: বিবিসি।