ড. আলী রীয়াজের পাথওয়েজ অব অটোক্রেটাইজেশন বইয়ের আলোচনায় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা

'বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র ঠেকাতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোটগত পদক্ষেপ প্রয়োজন'

'বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র ঠেকাতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর  জোটগত পদক্ষেপ প্রয়োজন'

বিশেষ সংবাদদাতা

বাংলাদেশে হাইব্রিড সরকার ব্যবস্থা থেকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে। এই স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে দেশের জনগণকে মুক্তি দিতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোটগত ভূমিকা পালন করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য মিত্রদের শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে  কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজের লেখা বই 'পাথওয়েজ অব অটোক্রেটাইজেশন: দ্য ট্যমুলচুয়াস জার্নি অব বাংলাদেশি পলিটিকস' শীর্ষক বইয়ের ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন- রাইট টু ফ্রিডম (আরটুএফ)।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আরটুএফ'র প্রেসিডেন্ট অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলাম। সংস্থাটির বোর্ড মেম্বার ও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান জন এফ ড্যানিলোয়িচের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বইয়ের লেখক প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ, উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান, জিনদাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রফেসর ড. শ্রীরাধা দত্ত এবং ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. আহমেদ শফিকুল হক। অনুষ্ঠানে আলোচকদের পরিচিতি তুলে ধরেন রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী।

নিজের লেখা বই প্রসঙ্গে প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, "এই বইয়ের লক্ষ্য হচ্ছে দুটি। প্রথমত গণতন্ত্রের অবক্ষয়, বিশেষ করে স্বৈরতান্ত্রিকতার পথে যাত্রা নিয়ে গত দেড় দশকের বেশী সময় ধরে যে সব আলোচনা আছে সেখানে যে বিষয় অনুপস্থিত তার দিকে মনোযোগ দেয়া। এই সব আলোচনায় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে, সেগুলোর পাশাপাশি নিজেদের ক্ষমতা বৈধ করতে যে ক্ষমতাসীনরা যে আদর্শ বা আইডিওলজি  ব্যবহার করে তা দেখানো। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে কীভাবে স্বৈরাচারীকরণ হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নের তিনটি সূচনা সময় হল- ১৯৭২, ১৯৯১ এবং ২০০৯।"

তিনি বলেন, "২০২৪ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে আমি বইটি লিখেছি। ২০০৯ সাল থেকে আমি যেটা লক্ষ্য করছি এবং অনেকেই লক্ষ্য করেছেন, ফ্রিডম হাউস এবং অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের গুরুতর অবক্ষয় ঘটেছে।"

ড. রীয়াজ বলেন, "কীভাবে সংবিধানে পরিবর্তন করা হয়েছে, কীভাবে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়েছে এ বিষয়গুলো বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং কম্বোডিয়া, তুরস্ক, হাঙ্গেরিসহ অন্য দেশ নিয়ে এ বইয়ে আলোচনা রয়েছে। যেসব দেশের সরকার প্রধানরা গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্তের পথে এগিয়েছে। তারা নিজেদের এ কাজকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে এক ধরণের আদর্শের বাতাবরানে।" এ কাজে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভিমিকা পালণ করছে, একদিকে মিডিয়া স্বৈরতন্ত্রের প্রথম টার্গেটে যেমন পরিণত হয়েছে তেমনি এই স্বৈরতন্ত্রের বিকাশের মিডিয়ার একটি অংশ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবক্ষয়ে বাইরের দেশের প্রভাব প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, "বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাইরের প্রভাবকদের ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চীন এবং ভারতের ভূমিকা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবক্ষয় এবং স্বৈরতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠায় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ভারত। ২০০৯ সালে থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এখন পর্যন্ত ভারতের অকুন্ঠ সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে।"

তিনি বলেন, "বিশ্ব রাজনীতির এজেণ্ডা হিসাবে চীন অর্থনৈতিকভাবে এখানে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে। এই সরকারকে অব্যাহত সমর্থনে দেশটির ভূমিকা রয়েছে। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট। কিন্তু এই অবক্ষয়ের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকেও দায়ী করতে চাই । আমার বইয়ে লিখেছি পশ্চিমা দেশগুলোর অবজ্ঞা এবং মূলত তাদের নিরবতার কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের এই নিরবতায় এই সরকার শুধু যে স্থায়ীত্ব এবং টিকে থাকতে সহায়তা করছে তা নয় বরং এটা এই সরকারকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছে।"

কুগেলম্যান তার বক্তব্যে বলেন, "বাংলাদেশে নির্বাচনের পূর্বে যে পরিস্থিতি ছিলো একইরকমের পরিবেশ আমরা ভারতে দেখতে পাচ্ছি। একই অবস্থা আমরা পাকিস্তানে দেখেছি। বিরোধীদল এবং ভিন্নমতের ওপর আক্রমণ এবং বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সরকারের হয়রানির ঘটনা ঘটছে।"

ভারত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে যাবার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি তার হিন্দু জাতীয়তাবাদ এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যান তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে হিন্দু জাতীয়বাদের দ্বারা সৃষ্ট নিপীড়নমূলক আচরণ। মোদি যদি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করেন তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে নিপীড়নমূলক আচরণের আশঙ্কা।"

বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতিসহ বেশ কিছু চাপ প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ এবং ভারতের ব্যাপারে কেন এই ধরনের ভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হলো? বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসাবে গণতন্ত্র বিকাশ নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বেছে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখি।"

তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কৌশলগত গুরুত্বের কারণে ভারতের চাইতে ভিন্ন চোখে দেখে। কিন্তু কৌশলটা এরকম না যে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগের কোন ইচ্ছা নেই। নির্বাচনের পূর্বে পরিস্থিতিটা এমন ছিলো। আমি মনে করি নির্বাচন শেষ হবার পর বাংলাদেশ নিয়ে নতুন কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ঘনিষ্ট করছে যুক্তরাষ্ট্র।"

প্রফেসর শফিকুল হক বলেন, "বাংলাদেশ অনুগত মিডিয়ার বিকাশ ঘটেছে। অধিকাংশ মিডিয়ার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেনা। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি দ্বারা মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই কোম্পানির মালিকেরা হচ্ছে স্বৈরশাসকের মিত্র।"

তিনি বলেন, "আমি বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কথা বলেছি। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে তারা প্রত্যাশা করছে যুক্তরাষ্ট্র যেন সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং কূটনীতিকভাবে একঘরে করে দেয়। তারা চাইছে মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যেন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর বাইরে তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছে যার মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকার বাধ্য হবে মানবাধিকার এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে।"

শফিকুল হক আরও বলেন, "বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার আরেকটি জায়গা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তারা চায় এই সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখুক। বাণিজ্য চুক্তি, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং বিদেশি বিনিয়োগ--এগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে করে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয় স্বৈরাচারি আচরণ থেকে সরে আসতে।"

প্রফেসর শ্রীরাধা বলেন, "বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশেই নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। বিএনপির যে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। আওয়ামী লীগ বিএনপির সেই দুর্বলতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সফল হয়েছে। আমি মনে করি বিএনপির সে বাধা কাটিয়ে উঠার সুযোগ রয়েছে। ভারতেও একই ধরনের দুর্বলতা দেখতে পাই। বাংলা, উড়িষ্যা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলোত যোগ্য নেতৃত্ব রয়েছে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে খেয়াল করলে আমরা নেতৃত্বের সংকট দেখতে পাই। কংগ্রেস রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ভারতের নেতৃত্বের সংকটের এই সুযোগ নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।"

প্রশ্নোত্তর পর্বে কুগেলম্যান বলেন, "সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নিবার্চনটি বিএনপির বয়কট করাটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিলোনা। বরং তারা নির্বাচনে না গিয়ে আওয়ামী লীগকে এমন সুবিধা করে দিয়েছে যে দলটি কারচুপির জন্য খুব বেশী কষ্ট করতে হয়নি। এটা খুবই অযৌক্তিক এবং হাস্যকর একটা বিষয়।আওয়ামী লীগ সরকার এখন যে অবস্থানে রয়েছে সেই অবস্থান  থেকে তাদের বিরত রাখতে পারতো বিরোধীদল।"

তিনি বলেন, "বিরোধীদলের সমর্থকরা নির্বাচনে যাবার ক্ষেত্রে অনিয়মের আশঙ্কা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার যে দাবি তুলেছে সেটা আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। এগুলোর প্রয়োজনের কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমার মতামত হচ্ছে, বিরোধীদল যদি নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন চলাকালীন সময়ে বেশী করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাইতো এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বেশী করে চাপ প্রয়োগ করতে চাইতো তাহলে তারা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতোনা এবং আওয়ামী লীগও খুব সহজে কারচুপির সুযোগ পেতোনা।"

আলী রীয়াজ বলেন, "বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত ছিলো কী ছিলোনা প্রসঙ্গে কুগেলম্যান যে মন্তব্য করেছেন সেটি নিয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর মুর্হূতে এক ডিআইজির নেতৃত্বে পুলিশের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা পুনরায় চালু করা হবে এবং তাদের গ্রেফতার করা হবে। এই বৈঠকের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যদের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা চালু করা এবং গ্রেফতার নিয়ে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। পুলিশ এবং বিচার বিভাগ মিলে একজোট হয় বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এটা বুঝা খুব সহজ বিএনপি কেন নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে ৩১ অক্টোবর কিংবা ১ নভেম্বর সিদ্ধান্ত নেয়নি। স্বৈরাচার সরকার এভাবেই তাদের নাটক মঞ্চায়ন করে।"

তিনি আরও বলেন, "বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে কী লাভ হয়েছিলো? আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নির্বাচন দেখে কী পদক্ষেপ নিয়েছিলো? কেউ কেউ বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনটা ভিন্ন হতে পারতো। এটা কী এই কারণে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটা বিবৃতি দিয়েছে। গত বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসা নীতি ঘোষণা করে তখন থেকে আমি বারবার এ কথা বলেছি যে, ওয়াশিংটনে বসে যদি কেউ এটা ভাবে যে ভিসা নীতি ঘোষণা করলেই বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তারা ভুল বুঝেছেন। এটা সহজ হিসাব। এটা কল্পনা মাত্র।"

আলী রীয়াজ বলেন, "এখন বলতে পারেন আতংকগ্রস্থ বিরোধীদলের কথা। সরকার নির্যাতন করে বিএনপির মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলো। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ এবং এরপর ২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের আচরণ বিএনপিকে নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলো। বিএনপির এখানে সিদ্ধান্ত নেবার মতো কোনো বিষয় ছিলোনা বরং একটি পক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিবেনা।"

তিনি বলেন, "সরকার ভেবেছিলো তারা বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিবে। কিন্তু তাদের সে ইচ্ছা সফল হয়নি। বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি তাতে আমার মনে হয়েছিলো হয়তো বিএনপিতে ভাঙন দেখা যেতে পারে। কিন্তু দলটি এই বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। আলোচকরা শক্তিশালী যে বিরোধীদলের কথা বলেছেন সে বিষয়ে আমি একমত কিন্তু এরকম বিরোধীদল থাকার জন্য সুনির্দিষ্ট একটি পরিবেশ থাকতে হয়।"

ড. রীয়াজ  বলেন, "কম্বোডিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাকালে আমরা দেখতে পাই কীভাবে বৈধ এবং অবৈধ পদক্ষেপের মাধ্যমে বিরোধীদলকে দুর্বল করে রাখা হয়। ২৯ অক্টোবর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির ১৫ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। দ্য ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০২৩ সালে অতিরিক্ত সময়ে আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। আদালত বসানো হয়েছে সন্ধ্যার পরও। কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষীকে আদালতে তলব করা হয়নি বরং পুলিশকে তলব করা হয়েছে। এমন এক পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। আপনারা কী আশা করেছিলেন বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিতে ঝাপ দিবে? তারা অংশ নিতে পারতো, তাদের অংশ নেওয়া উচিত ছিলো-এটা মনে করেন? আমি এটা মনে করিনা।"

বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবার চাইতে কথা বলেছে বেশী। আসলে দেশটি শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বরং কথাই বলেছে শুধু। বাইডেন প্রশাসন নীতির জায়গা থেকে কূটনৈতিক চাল চালিয়ে যাবার কথা ছিলো তার সমর্থনে আসলে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ ছিলোনা। আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো উদাহরণ তৈরি করবে কিন্তু তারা তা করেনি। দেশটি ভূ-রাজনৈতিক অন্য ইস্যুতে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছিলো।"

আলী রীয়াজ বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা ছিলো, জনগণ প্রত্যাশা করেছিলো এবং আরও অনেক বিষয় ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে প্রত্যাশা ছিলো তারা সেটা পূরণ করতে পারেনি। তারা পদক্ষেপ নেবার বদলে শুধু কথাই বলেছে।"

শফিকুল হক বলেন, "স্বৈরতন্ত্রের বিকাশে বিরোধীদলের দুর্বলতা ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে, বাংলাদেশে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করাটা সহজ কোনো কাজ না। এমনকি স্বাধীনতার পূর্বেও একই অবস্থা ছিলো। সেনাশাসকরা বিরোধীদলের সঙ্গে খুব কঠিন আচরণ করতো। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ধরনের শাসকের অধীনে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে। শাসকরা চান দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অবদান রাখতে কিন্তু দলগুলোর নেতৃত্বের সংকটের কারণে এই ইচ্ছার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়না। নেতৃত্বের সংকটের কারণে দল এবং আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।"

তিনি বলেন, "১৯৯০ সালের সব নেতারা আন্দোলনে এক হয়েছিলেন। কিন্তু এ সংকট কেটে যাবার পরই একদল আরেক দলের অবদানের কথা ভুলে যায়। যে দল ক্ষমতায় যায় তারা মনে করে এটা তাদের প্রাপ্য পুরস্কার। এরপর ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।"

শফিকুল হক বলেন, "যেভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে সেভাবে চলতে থাকলে বিরোধীদলকে পুরোপুরি দমন করা এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এখন দেশে তাই ঘটছে।"

তিনি বলেন, "শ্রীরাধা যেমনটা বলেছেন, বিরোধীদল বিএনপি সম্ভবত তাদের দুর্বলতার কারণে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারছেনা। তার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত কিন্তু একইভাবে এটা ক্ষমতাসীন দলের তৈরি করা একটি সমস্যা, তারা কোনো ধরনের বিরোধীতাকে গ্রহণ করছেনা। তারা অব্যাহতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বিরোধীদলগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট দলে ভাগ করতে যাতে তারা সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরতন্ত্রের বিকাশে বিরোধীদলের দুর্বলতার যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি সরকারের বিরোধীদলকে শক্তিশালী অবস্থান না যেতে নিপীড়ন করাটাও স্বৈরতন্ত্রে ভূমিকা রাখছে।"

আলী রীয়াজ  বলেন, "যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো বিরোধীদলই ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে এগুয়নি। এটা কখনো হয়নি। হঠাৎ যখন দেশটি যখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কবলে পড়ে গেলো তখন আমরা বিরোধীদলগুলোর কাছে প্রত্যাশ করছি তারা কীভাবে এই স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত থাকবে তার একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনা।"

তিনি বলেন, "যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়নি, স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে বলতে হয় ১৯৯১ সাল থেকে, যেখানে গণতন্ত্র বিকাশের কোনো পথই খোলা নেই সেখানে বিরোধীদলের কাছে থেকে এমন প্রত্যাশা করাটা দুরূহ । শুধু বিএনপি নয় আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকলেও আমি একথাই বলতাম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ কী ধরনের ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে বেছে নিয়ে ছিলো? তারা কী বলেছিলো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেওয়া হবে? না। তারা এটা বলেনি। তারা কী বলেছিলো ক্ষমতা একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে? না। তারা বলেনি। তারা কী বলেছিলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে গণতন্ত্রের অধিকার হরণ নিয়ে কোনো কথা বলা যাবেনা? না, তারা বলেনি। তাহলে তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী ছিলো? এখানে মূল সমস্যা যেটা আমি মনে করি, সেটা হলো সুশীল সমাজ কী ধরনের ভূমিকা পালন করলো সেটা, শুধু বিরোধীদলকে দায়ী করলে হবেনা।"

আলী রীয়াজ বলেন, "১৯৯০ সালে যা ঘটেছিলো সে সময়কার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। রাষ্ট্রের পেশী শক্তি এখন ব্যাপক মাত্রা লাভ করেছে। যদিও এটা আগে থেকে শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের মাত্রা ব্যাপক বেড়েছে। রাষ্ট্রের নজরদারির দিকেই খেয়াল করুন, যদি এখনকার সরকারের সঙ্গে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেনা শাসনের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে অনেক তফাত। কারণ এই সরকারের যে সামর্থ রয়েছে তার সঙ্গে কোনোভাবেই আগের শাসকদের তুলনা করা যাবেনা। প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তির এই বিকাশ সরকারকে সুবিধা দিচ্ছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের একটি অংশ দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।"

আদালতের রায় কিংবা সংসদীয় কমিটির মতামত নয় বরং এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, "জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার অংশ হিসাবে দুর্নীতি, ডিজিএফআই এবং আমলাতন্ত্র প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলো ক্ষমতার সুবিধাভোগের অংশ। সরকারের মূল ব্যবস্থাপনা দুর্নীতির ওপর নির্ভরশীল বলেই এর বিকাশ ঘটছে।"

স্বাগত বক্তব্যে মাইলাম বলেন, "আমি পেশার শুরু থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসছি। বাংলাদেশের এই যাত্রাটা বিপদসংকুল এবং আবেগের। আমি দেশটিতে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিলাম। বেশ ভালো সময় ছিলো তখন। আমি বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। সেসময়টাতে ছিলো গণতন্ত্রের উত্তরণ, আমি তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। গণতন্ত্রের এই যাত্রার দীর্ঘ সময়টাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অনেকে দেশ ছাড়া হয়েছে।"

তিনি বলেন, "বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রার সময়টাতে যে পরিস্থিতি ছিলো, যখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, সে পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে।"

এমআর/