করোনা থেকে সুস্থ হলেও ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

করোনা থেকে সুস্থ হলেও ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

কারও শরীরে যদি কোভিড-১৯ ভাইরাসের অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে কয়েকটি দেশের সরকার। এসব ব্যক্তি ফের সংক্রমিত হবেন না ধরে নিয়ে বলা হচ্ছে, তাদেরকে হয়তো ভ্রমণ বা কর্মস্থলে ফেরার অনুমতি দেয়া যায়। এ বিষয়ে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এক বৈজ্ঞানিক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ও শরীরে অ্যান্টিবডি জন্মেছে, এমন ব্যক্তিরা আর কখনই সংক্রমিত হবেন না, এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোনো ভাইরাসের বিপরীতে শরীরে ইমিউনিটি বা সুরক্ষা সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াটি একাধিক ধাপে হয়। এটি হতে সাধারণত ১-২ সপ্তাহ প্রয়োজন হয়। শরীরে ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হলেই শরীর থেকে সহজাত এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে শরীরের ম্যাক্রোফেজ, নিউট্রোফিলস ও ডেন্ট্রিটিক সেলসমূহ ভাইরাসের গতিকে স্লথ করে দেয়।

এমনকি এর ফলে সংক্রমণের লক্ষণও অনেকসময় দেখা যায় না। এরপর শরীর থেকে দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া আসে। প্রথম প্রতিক্রিয়া অনির্দিষ্ট হলেও, এবার সুনির্দিষ্টভাবে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষম অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে শরীর। এসব অ্যান্টিবডি হলো এক ধরণের প্রোটিন, যাকে ইমিউনোগ্লোবুলিন্স বলা হয়। এছাড়াও শরীর এক ধরণের টি-সেল তৈরি করে, যেটি ভাইরাসে আক্রান্ত সেল বা কোষ খুঁজে বের করে ধ্বংস করে দেয়। একে বলা হয় সেলুলার ইমিউনিটি।

এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে হয়তো ভাইরাস দূর হয়ে যেতে পারে। আর ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে সংক্রমণ থেকে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয় না। এমনকি পরবর্তীতে একই ভাইরাস আর শরীরে আঘাত করতে পারে না। এই প্রক্রিয়া পরিমাপের জন্য রক্তে কী পরিমাণ অ্যান্টিবডি আছে তা পরিমাপ করা হয়।

কোভিড-১৯ বা সার্স-কভ-২ সংক্রমণের বিপরীতে রোগীদের শরীরে কী ধরণের অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, সেই সংক্রান্ত প্রমাণাদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যালোচনা করা অব্যাহত রেখেছে। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, বেশিরভাগ গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সংক্রমণ থেকে সেরে উঠা বেশিরভাগ মানুষের শরীরেই অ্যান্টিবডি রয়েছে। কিন্তু কিছু রোগীর রক্তে খুবই সামান্য মাত্রার অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, এ থেকে বোঝা যায়, শুধু অ্যান্টিবডি নয়, প্রথম সাধারণ প্রতিক্রিয়া বা সেলুলার ইমিউনিটিও এই রোগ থেকে সেরে উঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২৪ এপ্রিল নাগাদ এখন পর্যন্ত এমন কোনো গবেষণা হয়নি যে, কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিপরীতে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি কারও শরীরে উপস্থিত থাকলে, তিনি ওই ভাইরাস পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত কিনা।

এছাড়া র্যা পিড ইমিউনোডায়ানোস্টিক টেস্ট সহ মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিপরীতে অ্যান্টিবডি শনাক্ত করার যে ল্যাবরেটরি টেস্ট রয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা উচিত। ভুল ইমিউনোডায়াগনস্টিক পরীক্ষার কারণে দু’ ধরণের সমস্যা হতে পারে। প্রথমত, অনেক মানুষ যারা সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের ভুলভাবে নেগেটিভ আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, অনেকের শরীরে ভাইরাস আর নেই, কিন্তু তাদেরও পজিটিভ চলে আসতে পারে। উভয় ভুলই গুরুতর বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করতে পারে।

মূলত, এসব পরীক্ষায় পুরোনো সংক্রমণকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারতে হবে। এছাড়া শরীরে যে আরও ছয়টি প্রচলিত করোনাভাইরাস হয়, সেগুলোর সংক্রমণকেও শনাক্ত করতে হবে। কেননা, এদের মধ্যে ৪টি ভাইরাসই সর্দি জ্বর সৃষ্টি করে, ও ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে। বাকি দু’টো হলো মার্স ও সার্স। এই সবগুলো ভাইরাস থেকেই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। এবং সেসব অ্যান্টিবডিও কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

অনেক দেশই এখন জনসাধারণ বা বিশেষ গোষ্ঠী, যেমন স্বাস্য্তসেবা কর্মী, রোগীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের শরীর কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিপরীতে উৎপন্ন অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করছে। এসব গবেষণাকে স্বাগত জানায় ডব্লিউএইচও, কেননা সংক্রমণের প্রকৃত মাত্রা ও এগুলোর রিস্ক ফ্যাক্টর বুঝতে এসব পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে বোঝা যাবে, শনাক্তযোগ্য কোভিড-১৯ অ্যান্টিবডি কত শতাংশ মানুষের শরীরে পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব গবেষণার বেশিরভাগ থেকেই বোঝা যাবে না যে, অ্যান্টিবডি সম্পন্ন মানুষ দ্বিতীয়বার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকবেন কিনা।

অতএব, মহামারির এই পর্যায়ে অ্যান্টিবডি-নির্ভর ইমিউনিটির কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। ফলে ‘ইমিউনিটি পাসপোর্ট’ বা ‘ঝুঁকিমুক্ত সনদ’ কতটা সঠিক, সেটি নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। ফলে যারা একবার আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন তারা হয়তো ধরে নিতে পারেন যে তাদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ঝুঁকি নেই। ফলে তারা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শগুলো উপেক্ষা করে যাবেন। এ কারণে এ ধরণের ‘সনদ’ ব্যবহার করা হলে তা বরং অব্যাহত সংক্রমণের ঝুঁকিই বৃদ্ধি করবে। নতুন কোনো প্রমাণ বা ফলাফল পাওয়া গেলে, ডব্লিউএইচও এই নির্দেশিকা হালনাগাদ করবে।

এমজে/