নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি

নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি

‘করোনার লক্ষণ দেখা গেলে কোথাও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছিলাম না। কীভাবে পরীক্ষা করাব সে জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম। কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর কয়েকজনের সুপারিশে জাতীয় প্রেসক্লাবের নমুনা সংগ্রহের বুথে ১৭ জুন নমুনা দিলে সাত দিন পরে ২৪ জুন রাতে ফোন করে জানানো হয়—আমার করোনা পজেটিভ। সেই থেকে মিরপুরের বাসায় আইসোলেশনে আছি।’

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী আতাউর রহমান।

তিনি বলেন, পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার ১২ দিন শেষে আবার দ্বিতীয় বার নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রেসক্লাবে যোগাযোগ করি। তারা, বলেন ২১ দিন না গেলে নমুনা পরীক্ষা করা যাবে না। এদিকে আমি পুরোপুরি সুস্থ। নেগেটিভ সার্টিফিকেটের জন্য অফিস করতে পারছি না। অফিসের আরেক সহকর্মীর সহযোগিতায় মিরপুর ১৪ নম্বরে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বুথে নমুনা পরীক্ষার জন্য গেলে সেখানে একদিন পরে সিরিয়াল পাই। ৫ জুলাই নমুনা দিয়ে আসি। তারা বলেছে, ৮ থেকে ১০ দিন পর নমুনা পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে। এখন অফিসিয়ালি নেগেটিভ ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন মাটিকাটা এলাকায় বসবাস করেন এক ব্যাংক কর্মকর্তা। হঠাৎ করে ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পেলে অফিস থেকে বলা হয় কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য। পাশাপাশি করোনা নেই—এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট সঙ্গে নিয়ে যেতে বলা হয়।

এ ব্যাংক কর্মকর্তার অভিযোগ, রাজধানীর বেশ কয়েকটি জয়গায় যোগাযোগ করে তিন দিনের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করা গেল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিভার ক্লিনিকে নমুনা পরীক্ষার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে তিন-চার দিন চেষ্টা করার পরেও সুযোগ পাননি। ব্যর্থ হয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাধ্যমে প্রথমে নিজের নমুনা পরীক্ষা করান। পজেটিভ রিপোর্ট এলে পরবর্তীতে পরিবারের ছয় সদস্যের সবার নমুনা পরীক্ষা ব্র্যাকের মাধ্যমে করালে অনেক টাকা ও সময় অপচয় হয়েছে বলে জানান ওই ব্যাংক কর্মকর্তা।

গণমাধ্যমকর্মী জাহিদ হাসান বলেন, কোভিড-১৯ পজেটিভ আসলে দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউ’র অনলাইনে বহুবার চেষ্টার পরও রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। পরবর্তীতে ওই হাসপাতালে পরিচিত এক চিকিৎসকের মাধ্যমে ফিভার ক্লিনিকে নমুনা পরীক্ষা করি। তাতে আমার নেগেটিভ আসে। কিন্তু এতেও ভোগান্তি কম পোহাতে হয়নি।

শুধু আতাউর রহমান কিংবা জাহিদ হাসান নয়; দেশের হাজার হাজার মানুষ নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভোগান্তির জন্য নমুনা পরীক্ষাই করছেন না, এমন অভিযোগ করেছে।

ইস্কাটন গার্ডেনে বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। তাদের একজন তাপস রায়। তিনি বলেন, সবার মধ্যে কিছু না কিছু লক্ষণ আছে। সবাই শারীরিকভাবে সুস্থ। রাজধানীতে নমুনা পরীক্ষা করা খুবই কঠিন। নমুনা পরীক্ষা করতে গেলে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। অনেক সময় অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়। এ যুদ্ধ করে নমুনা পরীক্ষা করলেই পজেটিভ আসবে। তখন সবার মধ্যেই একটা ভয়-ভীতির সৃষ্টি হবে। এর চেয়ে বরং পরীক্ষা না করেই সাধারণভাবে যদি বেঁচে থাকা যায়, তাই ভালো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রথম দিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) একটি মাত্র ল্যাব নিয়ে নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে সারাদেশে ৭৬টি ল্যাব আছে। ঢাকার ভেতরে ৪২টি ও ঢাকার বাইরে ৩৪টি ল্যাব আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ ল্যাবগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৮৬২টি। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৫ হাজার ৬৩২টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে নয় লাখ চার হাজার ৭৮৪টি। প্রতিনিয়ত ল্যাব, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন অনলাইনে ৩০০ জন রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। এখন যদি প্রতিদিন ১ হাজার মানুষ ট্রাই করে তাহলে তো কম্পিউটারের সফটওয়্যার সবসময় ব্যস্ত থাকবেই। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে যারা আগে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন তারাই নমুনা পরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন। আর ৩০০ একজন পূর্ণ হয়ে গেলে কম্পিউটার সফটওয়্যার তো ব্যস্ত দেখাবে। যদি সফটওয়্যার ব্লক করে সিরিয়াল বিক্রি করা হয়— এমন অভিযোগ থাকে তবে আমরা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

হতদরিদ্র মানুষ যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না তারা কীভাবে নমুনা পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করবেন— এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, হতদরিদ্র মানুষ যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না তারা আমাদের ফিভার ক্লিনিকের চিকিৎসকের পরামর্শে সরাসরি নমুনা পরীক্ষা করতে পারবেন। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, আমাদের ডিজি হেলথ অফিসে একটা সফটওয়্যার আছে। এই সফটওয়্যারের মধ্যে আসলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেজাল্ট জানা যায়।

তিনি বলেন, দেশে এখনো ল্যাব স্বল্পতা আছে। আবার কোন কোন ল্যাবে জনবল কম থাকার কারণে অনেক নমুনা ও রিপোর্ট জমা হয়ে যায়। অনেক নমুনা জমে থাকাকে ব্যাক লক সার্ভিস বলা হয়। এই ব্যাকলগ সার্ভিসের নমুনাগুলো যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় এনে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আবার অনেক জেলায় সফটওয়্যার না থাকায় নমুনার রিপোর্ট ঢাকায় আসছে তাই সময় লাগছে। আমরা সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। অচিরেই এই সমস্যার সমাধান হবে।

এমজে/