এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগ

এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগ

হাতিয়ার এসিল্যান্ড সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে ব্যাচমেটের সঙ্গে পরকীয়া, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব না নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে অভিযুক্ত এ কর্মকর্তা এখনো পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ নিচ্ছেন না এবং তাদের ভরণ-পোষণ দিচ্ছেন না মর্মে অভিযোগ তুলেছেন তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার। তিনি বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার পাচ্ছেন না। তার অভিযোগ, গুটিকয় প্রভাবশালী কর্মকর্তার কারণেই সারোয়ারের শাস্তি হচ্ছে না।

সারোয়ার সালাম বলেন, তাকে ফাঁসানোর জন্য স্ত্রী খাদিজা পরিকল্পিতভাবে এই অপবাদ দিচ্ছে। একই ব্যাচের নারী ওই সহকর্মীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই সহকর্মীর বর্তমান কর্মস্থল কোথায় সেটিও তিনি জানেন না।

সচিবালয় সূত্র জানায়, সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগগুলো হলো- স্ত্রী-সন্তানকে অধিকার বঞ্চিত করা, স্ত্রীকে মানসিক নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার হুমকি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনসহ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ২৫ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে যৌতুক দাবি এবং প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করার দুুুটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. ছাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়। এ চিঠি পাওয়ার পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ায় এসিল্যান্ড হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

জানা গেছে, খাদিজা আক্তার তার স্বামীর নামে ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং ২০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের সঙ্গে নির্যাতনের বিভিন্ন ছবি এবং ফোনকলের অডিও রেকর্ডের ক্লিপও জমা দেন। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে ১৯ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত। এই কমিটিই সারোয়ারের বিরুদ্ধে করা স্ত্রী খাদিজার ৬টি অভিযোগের মধ্যে চারটির প্রমাণ পেয়েছে।

এদিকে গত ৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতে বলা হয়েছে, সারোয়ার তার স্ত্রী-সন্তানকে ভরণ-পোষণ না দিয়ে অধিকার বঞ্চিত করেছেন। স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি ফৌজদারি প্রকৃতির। যা যাচাইয়ের জন্য উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ দ্বারা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে তালাক প্রদানের হুমকি ও পরকীয়ার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের বিষয়টির সত্যতা রয়েছে।

পরকীয়া সংক্রান্ত অডিও ক্লিপগুলোর কথোপকথন বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটি পরকীয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে ফোন রেকর্ডের অনেক কথাবার্তা উল্লেখ রয়েছে। অডিও ক্লিপের ২ নম্বর রেকর্ডে সারোয়ার সালাম তার স্ত্রী খাদিজা আক্তারকে বলেন, ‘তিনি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। তিনি অন্য আরেকজনকে বিয়ে করলে খাদিজা আক্তার যেন তার সঙ্গে বোনের মতো থাকে। তার হাতে এখন ২টি অপশন আছেÑ ডিভোর্স দেওয়া অথবা উইদাউট ডিভোর্স।’

খাদিজা আক্তার বলেন, ২০১৬ সালের মে মাসে সারোয়ার সালামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২০১৭ সালে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তারপর ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে স্বামী সারোয়ার তার একই ব্যাচের (৩৪ ব্যাচ) সহকর্মীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকেই তাদের সংসারে চরম অশান্তি নেমে আসে। তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে আসছিলেন স্বামী সারোয়ার। নির্যাতনের কারণে স্বামীর সঙ্গে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। গত বছর জুনে স্বামীর কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে এক মাস সংসার করেছিলেন। কিন্তু নির্যাতনের কারণে সেখানে আর থাকতে পারেননি।

খাদিজা আরও বলেন, স্বামীর নির্যাতনের কারণে তাকে একবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি হতে হয়েছিল। দুবার থানায় জিডিও করেছেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে বহু চেষ্টা করেছেন খাদিজা। তবু তিনি তা পারছেন না। খাদিজা বলেন, পরকীয়ার মোহে সে আমার ও আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী কন্যা শিশুটির খোঁজ নিচ্ছে না। সহকর্মীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজের সুখের সংসার তছনছ করেছে।

স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে সারোয়ার সালাম বলেন, এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো আমাকে কোণঠাসা করে রাখা। আমি যাতে আমার বাবা-মা, ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে না পারি সেই ব্যবস্থা করা। স্ত্রী খাদিজাকে গত সেপ্টেম্বরে তালাক দিয়েছেন বলেও দাবি করেন সারোয়ার। যদিও খাদিজার দাবি তিনি তালাকনামার কোনো কাগজপত্র পাননি।

এদিকে সারোয়ার সালামের সঙ্গে যার পরকীয়া সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে সেই কর্মকর্তাও একটি উপজেলার এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে সারোয়ার সালামের কোনো সম্পর্কই নেই। তার স্ত্রী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছিলেন। আমাকে অভিযোগের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। আমি জবাব দিয়েছি। তার স্বামী বর্তমানে বিদেশে পিএইচডি করছেন বলেও জানান ৩৪ ব্যাচের এই নারী কর্মকর্তা।

জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুণ বলেন, আইন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ উঠলেই আমরা তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারি না। তার ব্যাপারে আরও তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে সাধারণত ওএসডি করা হয়। সারোয়ার সালামকে ওএসডি না করে এক কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে একই পদে বদলি করা হয়েছে কেন এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে যেন কর্মকর্তাদের ওএসডি না করা হয়।

এমজে/