মিরপুর ডেমরা টঙ্গীতে বানের পানি

মিরপুর ডেমরা টঙ্গীতে বানের পানি

দেশের উত্তর, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের ৩১ জেলায় চলমান বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উত্তরাঞ্চল থেকে বানের পানি নামছে খুব ধীর গতিতে। কিন্তু দুই-একদিনের মধ্যে এ অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা বাদে আর সব নদীতে বাড়ছে বানের পানি।

উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে নেমে আসা পানি মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে ঢাকা শহরের মিরপুর, ডেমরা ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

ঈদুল আজহা আসন্ন হলেও প্লাবিত এলাকাগুলোতে ঈদের কোনো আমেজ নেই, নেই বানভাসিদের মনে কোনো সুখ। এদিকে প্লাবিত এলাকায় মানুষের বর্জ্য ও বানের পানি মিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় অধিবাসীরা রয়েছেন মারাত্মক বিপদে।

ইতোমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। একদিকে বানের পানি, অন্যদিকে বিশুদ্ধ সুপেয় পানির অভাবে প্লাবিত এলাকাগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বসতবাড়ির ঘরগুলোতে পানি ওঠায় বেড়েছে সাপ ও কীটপতঙ্গের উৎপাত।

এদিকে চলতি বন্যায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ১৫৪ বন্যা উপদ্রুত উপজেলায় ৯১৭ ইউনিয়নে ১০ লাখ ২১ হাজার ৮৩৪ পরিবার পানিবন্দি।

আগের দিনে ছিল ৯০৮ ইউনিয়নের ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮১৯ পরিবার পানিবন্দি। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ৪১ জন বন্যায় মারা গেছে। সব মিলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৮ জন। দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত এবং পানিবন্দি লোকের সংখ্যা বাড়ছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বৃষ্টিপাতের আগামী ১০ দিনের যে পূর্বাভাস আছে তাতে মনে হচ্ছে, মধ্য আগস্টের আগে আমরা বন্যামুক্ত হচ্ছি না। সব মিলে এবার প্রায় দেড় মাস স্থায়ী হতে পারে বন্যা।

 

এই পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম এবং নদী ও বাঁধ ভাঙন রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার পানি নিষ্কাশিত হয় মধ্যাঞ্চল দিয়ে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হলে এ পানির ঢেউ রাজধানীতেও লাগে।

আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বুলেটিনে দেখা যায়, দেশের ভেতরে ও বাইরে তিন দিন ধরে চলছে ভারি বৃষ্টিপাত। ফলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্য থেকে বানের পানি আসছে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) বলেছে, বর্তমানে ১৮টি নদী ২৭ পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার উপরে।

নদীগুলো হচ্ছে- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, ঘাঘট, গুড়, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, কালীগঙ্গা, আড়িয়ালখাঁ, মেঘনা ও তিতাস। গত পাঁচ-ছয় দিন ধরে বালু নদী রাজধানীর ডেমরা পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার মিরপুর পয়েন্টে তুরাগ ও টঙ্গীতে টঙ্গী খাল বিপদসীমার যথাক্রমে ১৬ ও ২৩ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর (ডিডিএম) বলছে, এ মুহূর্তে দেশের ৩১টি জেলা বন্যা উপদ্রুত। জেলাগুলো হচ্ছে- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নাটোর, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, মৌলভীবাজার ও গাজীপুর।

ডেমরা (ঢাকা) : ঢাকার বালু নদ তীরবর্তী বন্যাকবলিত মানুষ ১৫ দিন ধরে বন্যা পানিবন্দি থাকলেও তাদের কাছে এখনও কোনো সাহায্য আসেনি। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ায় উঁচু স্থান ও অভ্যন্তরীণ ব্রিজের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে অনেককে। সেই সঙ্গে গবাদি পশুগুলোকে রাস্তা বা ব্রিজের মধ্যে রাখতে হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বালু নদ তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের এলাকাগুলো বানের পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তা, কৃষিজমি ও বাড়ির আঙ্গিনা। অধিকাংশ বাড়িঘরেও প্রবেশ করেছে পানি। ২৪ ঘণ্টায় পানি আবারও কিছুটা বেড়েছে। এলাকার কিছু কিছু প্রধান সড়কেও বালু নদের পানি এসে পড়েছে। ঢাকা-৯ আসনের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, প্লাবিত এলাকার বন্যা পরিস্থিতি আমি দেখছি। বন্যাকবলিতদের মাঝে এখনও কোনো সরকারি সহযোগিতা বা ত্রাণ সহায়তার অনুমোদন হয়নি। তবে সরকারি অনুমোদন হলেই আমরা ব্যবস্থা নেব।

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) : মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদীতে তিন দিন ধরে পানি স্থির থাকলেও মঙ্গলবার রাত থেকেই আবারও পানি বাড়তে শুরু করেছে। এসব এলাকার চারদিকেই থই থই পানি। বন্যার পানিতে ভাসছে লৌহজং উপজেলার ১০ ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম। বুধবার বেলা ১১টায় লৌহজংয়ের চরাঞ্চলের শতাধিক পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার।

টাঙ্গাইল : বন্যার পানির স্রোতে বুধবার ভোরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নওগাঁ গ্রামে এলানজানি নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে সদর, বাসাইল ও কালিহাতী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রাম জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে সব কটি নদীর পানি। বানভাসি মানুষ ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে।

সিলেট : কমতে শুরু করেছে সিলেটের নদ-নদীর পানি। এতে উন্নতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। সিলেটের নদীগুলোর মধ্যে কেবল কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

শেরপুর : শেরপুরের ১৩টি ইউনিয়নের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। শেরপুর ব্রহ্মপুত্র সেতুর কাছে ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনও বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্দর (নারায়ণগঞ্জ) : নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুধবার থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে মঙ্গলবার রাত থেকে আবারও পানি বাড়ছে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে চতুর্থ দফা বন্যায় আগামী মৌসুমি ফসল উৎপাদন পুরোটাই ব্যাহত হওয়াসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় ভুগছেন উপজেলাবাসী।

দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) : দেওয়ানগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যমুনা নদীতে পানি কমলেও ৪৫ দিন ধরে আটকে পড়া ২ লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে।

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের সব ফসলি জমি ও নিচু সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

রাজশাহী : বন্যায় রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় সাত লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নষ্ট হয়েছে ২৭ হাজার ৭৭৩ হেক্টর জমির ফসল। বুধবার সন্ধ্যায় এক তথ্য বিবরণীতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে কমছে। ফলে সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার চরাঞ্চল থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। এসব এলাকার বেশিরভাগ ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও অনেক বাড়িঘর পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে।

মধুপুর (টাঙ্গাইল) : টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের হাসিল গ্রামের মধ্য পাড়ার জামে মসজিদের অধিকাংশ বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে। স্থানীয়রা মসজিদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পানি থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। বুধবার সকালে মসজিদটি ভেঙে পড়ার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত স্থানীয়রা মসজিদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো পানি থেকে উদ্ধার করেছেন।

এমজে/