মহাবিপদে রেমিট্যান্সযোদ্ধারা: সৌদি শ্রমবাজারে অশনিসংকেত

মহাবিপদে রেমিট্যান্সযোদ্ধারা: সৌদি শ্রমবাজারে অশনিসংকেত

সময় যত গড়াচ্ছে করোনার কারণে দেশে আটকে পড়া প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সংকট বহুমাত্রিক। অনেকের ভিসা ও ইকামা (কাজের অনুমতি) আছে। কফিল (নিয়োগকারী) দ্রুত ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন, না গেলে চাকরি হারানোর শঙ্কা আছে। কিন্তু সৌদিতে ফিরে যাওয়ার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকের ভিসা ও ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ভিসার মেয়াদ বাড়াতে ঢাকায় আবেদনের জন্য যে ধরনের কাগজপত্র দরকার, সেগুলো সৌদি আরব থেকে সহজে মিলছে না। এর ফলে ভিসাও নবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে করোনা মহামারির আগে সৌদিতে প্রথমবারের মতো কাজে যাওয়ার জন্য প্রায় ২৫ হাজার কর্মী ভিসা নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা আর যেতে পারেননি। তাদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন করে ভিসা নিতে বলা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে ঢাকায় সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশ গুলোর মিশনপ্রধানদের সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নিয়োগকারী যদি তার কর্মীকে নিতে না চান সে ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। তিনি প্রবাসী কর্মীদের তাদের নিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, করোনা শুরু হওয়ার পর (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরে ৩৯ হাজার ১৮৮ জন বাংলাদেশি, যাদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই করোনার কারণে কর্মস্থল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। গত ছয় মাসে এদের মধ্যে অনেকে দেশে ঋণের বেড়াজালে আটকেছে। অন্যদিকে গত এক সপ্তাহে সৌদি আরব ফিরে যেতে পেরেছেন তিন হাজার ৩১৮ জন। সৌদি আরব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করলে ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে প্রবাসীরা সে দেশে ফিরতে শুরু করেন।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান জানান, ‘এ পর্যন্ত ১১টি ফ্লাইটে তিন হাজার ৩১৮ প্রবাসী সৌদি ফিরে গেছেন।’

জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে চাকরি নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সংখ্যা ছিল সাত লাখ। চলতি ২০২০ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে সাত লাখ। গত জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে বিদেশে মোট কর্মসংস্থানের ৮৮ শতাংশ কর্মী গেছে মধ্যপ্রাচ্যের ১০ দেশে। ৭৪ শতাংশই গেছে সৌদি আরবে। দেশটিতে প্রায় ২১ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় কর্মরত।

তবে সৌদি আরবের ২০৩০ ভিশন অনুযায়ী, পুরো শ্রমবাজারে ৭০ শতাংশই দেশটির নাগরিকদের নিয়ে আসার পরিকল্পনা। এটি বাস্তবায়নে অভিবাসী শ্রমিকদের ক্রমে ছাঁটাই করে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। শুরুতে অবৈধ ও আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশিদের নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এরপর বৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদেরও ফেরত পাঠানোর শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেছেন অভিবাসন বিশ্লেষকরা।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রার) সাবেক সভাপতি গোলাম মুস্তাফা গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা সৌদি আরবে গেছে, তারা কোনো অবস্থায়ই তাদের জন্য বোঝা নয়। আমাদের প্রবাসী কর্মীরা কৃষিসহ নানা কাজে যুক্ত হয়ে সৌদি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। তারা ছুটিতে দেশে এসে করোনার কারণে ফিরে যেতে পারছে না। যাদের নতুন ভিসা এসেছে, তাদের এবং যারা সৌদি আরবে কর্মরত তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা সৌদি সরকারের কাছে মানবিক বিবেচনার দাবি জানাই।’

তিনি বলেন, ‘যাওয়ার আগে আমাদের কর্মীদের করোনা নেগেটিভ সনদ থাকতে হবে ৪৮ ঘণ্টা আগের। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা খুবই কঠিন ব্যাপার। একদিকে তাদের ইকামার মেয়াদ বাড়াতে হবে ও কনফার্ম টিকিটও লাগবে, আবার ৪৮ ঘণ্টা আগের করোনা সনদও লাগবে—এসব কিছু করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটা ৪৮ ঘণ্টা না করে ন্যূনতম চার দিন সময় দেওয়ার জন্য সরকারের জোর কূটনৈতিক তৎপরতা নেওয়া দরকার।’

এদিকে প্রায় প্রতিদিনই টিকিট ও টোকেনের জন্য সৌদি প্রবাসী কর্মীরা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও হোটেলে অবস্থিত সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের অফিসের সামনে বিক্ষোভ করছেন। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতি জিইয়ে রাখা মানুষেরা এবার টোকেন নিতে গিয়ে লাঠিপেটার শিকার হচ্ছেন।

সৌদি প্রবাসীদের ফিরে যেতে যত ফ্লাইট লাগবে এর অনুমোদন দেওয়া হবে বলে সপ্তাহখানেক আগে জানিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস এখন সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তারা আরো চারটি ফ্লাইটের অনুমতি চেয়েছে, আমরা তা অনুমোদন দিয়েছি। এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সপ্তাহে ১০টি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করবে। অর্থাৎ সপ্তাহে এখন এই রুটে ১৮টি ফ্লাইট পরিচালিত হবে।’

এদিকে বেবিচক গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, করোনার কারণে প্রতিটি ফ্লাইটে যাত্রী বহনের ক্ষেত্রে আরোপিত সিট সংখ্যার সীমাবদ্ধতা (প্রশস্ত বিমানের জন্য ২৬০ এবং অপ্রশস্ত বিমানের জন্য ১৪০), ঢাকা থেকে সৌদি আরবের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বিমান বাংলাদেশ এবং সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের ক্ষেত্রে আগামী ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রশমিত করার জন্য বেবিচক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

প্রবাসী কর্মীদের সৌদি আরব ফেরাতে আরো ১২টি বিশেষ (নন-শিডিউল) ফ্লাইটের অনুমতি পেয়েছে বিমান। এ ছাড়া ভিসার মেয়াদ অনুযায়ী এখন থেকে টিকিট রি-ইস্যু করবে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সৌদি এয়ারলাইনস জানিয়েছে, ফরম যাচাই-বাছাইয়ে যাদের ভিসার মেয়াদ আগে শেষ হবে বলে দেখা যাবে, তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকিট পাবে। এত দিন সৌদি এয়ারলাইনস রিটার্ন টিকিটের মেয়াদ ধরে টিকিট রি-ইস্যু করেছে। টিকিট ক্রয়ের তারিখ ধরে এ সিরিয়াল অনুযায়ী টিকিট দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের সেলস ম্যানেজার ওমর খৈয়াম।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশি কর্মীদের বড় অংশই কাজ করে বেসরকারি খাতে। করোনার কারণে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি ভালো নয়। তা ছাড়া ঝুঁকির কারণে অনেকে কর্মীও নিতে চাচ্ছে না। এ কারণে গত মার্চ মাসে অনেক কর্মীর চাহিদা থাকলেও এখন তা নেই। গত মার্চ মাসে ভিসা পেয়ে যেতে পারেননি এমন কর্মীদের জন্য এখন নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশে যেতে না পারলে সরকার তাদের জন্য দেশেই প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে উৎসাহিত করবে। এ জন্য এরই মধ্যে ৫০০ কোটি তহবিল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে এই তহবিলের পরিমাণ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, অন্যদের মতো প্রবাসীরাও এর শিকার হয়েছে। অনেকেই করোনাকালে বা এরও আগে বাংলাদেশে এসে আটকে পড়েছে।

তিনি বলেন, এখন করোনা পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ায় সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে কর্মীরা যেতে শুরু করেছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে অনেকের সমস্যা আছে। কিছু সমস্যা, যেগুলো আমাদের আয়ত্তের মধ্যে আছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের নিয়ে জটিলতা আছে। তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার ও নিয়োগকারীরা বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে না। এখানে যা ঘটছে, সেদিকেও তারা নজর রাখছে। তারা যদি কর্মী নিতে না চায় বা ভিসা বাতিল করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের কিছুই করার থাকবে না।’

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ (রামরু) ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি আরব শুধু আমাদের সঙ্গে নয়, পুরো এশিয়ার মাইগ্র্যান্টদের সঙ্গে যে আচরণ করল, এটা অত্যন্ত অন্যায়। এখন আমাদের এই ইস্যুকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে সৌদি আরবের ওপর ব্যাপক কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে। ভারত, নেপালের মতো যারা এই সমস্যায় পড়েছে তাদের সঙ্গে নিতে হবে। যার ভিত্তিকে সৌদির দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে। সেখানকার কাফিল প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার একটি উদ্ভাবনী মেথড বের করতে হবে। অন্যান্য দেশের হাইকমিশনারদেরও সঙ্গে নিতে হবে।’

তিনি বলেন, প্রবাসী কর্মীরা দেশে এসে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সরকার শুধু ঋণ প্রকল্প দিয়ে এই সংকট দূর করতে পারবে না। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন নগদ অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করা দরকার। আমরা যে রেমিট্যান্স নিয়ে গর্ব করছি, সেই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের প্রতি মানবিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যারা ফিরে আসছেন, তাদের জেলে দেওয়ার ঘটনা প্রবাসী কর্মীদের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যারা জেলে আছেন, তাদের দ্রুত ছেড়ে দেওয়া এবং নতুনদের জেলে না নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি বৈশ্বিকভাবে আমরা প্রবাসীদের নিয়ে লড়াই করতে চাই, তাহলে নিজেদের দেশে তাদের প্রতি আরো মানবিক হতে হবে।

এমজে/