আদালতে চিকিৎসকের সাক্ষ্য

আবরারের লাশ হল থেকে সরাতে চাপ দিচ্ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা রাসেল

আবরারের লাশ হল থেকে সরাতে চাপ দিচ্ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা রাসেল

নির্যাতনে আবরার ফাহাদ যখন মৃত, তখন লাশ হল থেকে সরাতে বুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল চাপ দিচ্ছিলেন বলে আদালতে সাক্ষ্যে বলেছেন বুয়েটের চিকিৎসক মাসুক এলাহী।

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার আলোচিত মামলায় রোববার ঢাকার ১ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে সাক্ষ্য দেন এই চিকিৎসক।

বুয়েট চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক মাসুক গত বছরের ৬ অক্টোবর রাতে শেরে বাংলা হলে গিয়ে আবরারকে দেখে মৃত ঘোষণা করেছিলেন।

তার আগে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী তড়িৎ কৌশলের ছাত্র আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে নির্যাতন চালায়। এতে আবরার অচেতন হয়ে পড়লে তাকে হলের নিচতলার সিঁড়িতে রেখে চিকিৎসককে খবর দেয় তারা।

মামলার পঞ্চম সাক্ষী ডা. মাসুক বলেন, রাত ২ টা ৪৭ মিনিটে তাকে একজন ছাত্র তাকে খবর দিয়ে মেডিকেল সেন্টার থেকে অক্সিজেন নিয়ে যেতে বলে। তখন তিনি বলেন যে তিনি আগে রোগী দেখবেন, তারপর সিদ্ধান্ত দেবেন।

“তখন আমাকে ছাত্ররা উত্তর ব্লকের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। এক এবং দুই তলার মাঝখানে আবরার ফাহাদকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। তার পরনে একটি চেক শার্ট আর কালো রংয়ের ট্রাউজার ছিল। তোষক এবং ট্রাউজার প্রস্রাবে ভেজা ছিল।”

 

দেখেই আবরারকে মৃত মনে হয়েছিল এই চিকিৎসকের। এরপর পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হলে তা সেখানে ঘিরে থাকা ১৫/২০ জন ছাত্রকে বলেন।

“তখন আমি ছাত্রদের বলি যে আবরার ফাহাদ মারা গেছে। এটা শোনার পর সকল ছাত্ররা পালিয়ে যায়। সেখানে আমি আর আবরারের লাশ ছাড়া আর কেউ ছিল না।”

কিছুক্ষণ পর বুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাসেল উপস্থিত হন বলে জানান ডা. মাসুক।

ডা. মাসুক বলেন, “সে নিজের পরিচয় দেয় সে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। সে আমাকে আবরারকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলে। আমি বলি সে বেঁচে নেই, মারা গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করি।

“তখন রাসেল আমাকে বলে, ‘আবরার মারা যায়নি, সে ঘুমাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেও সে ঘুমাচ্ছিল’।”

রাসেল অন্য ছাত্রদের দিয়ে লাশ ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে অ্যাম্বুলেন্সেও তুলেছিল বলে জানান ঘটনার সাক্ষী এই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, “তখন আমি হলের প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল স্যারকে মোবাইলে ফোন দিয়ে আবরারে মৃত্যু সংবাদ জানাই। উনাকে তাড়াতাড়ি হলে আসতে বলি। তিনি ১০/১৫ মিনিটে হলে চলে আসেন।”

প্রাধ্যক্ষ আসার পর অ্যাম্বুলেন্স থেকে আবরারের লাশ স্ট্রেচারে করে নামিয়ে আনা হয়।

ডা. মাসুক বলেন, “এরপর স্ট্রেচারটি রাসেলের নির্দেশে হলের নিচতলার বারান্দায় নিয়ে যায়। এ সময় আমি একজন ছাত্রের কাছ থেকে চাদর নিয়ে লাশটি ঢেকে দিই। এর মধ্যে সিকিউরিটি ইন চার্জ আবুল কালাম আজাদ ঘটনাস্থলে আসেন, থানায় ফোন দেন। ১৫/ ২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করে।”

জবানবন্দি দেওয়ার পর আসামি হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বুয়েটছাত্রদের শনাক্ত করেন ডা. মাসুক। সকাল সোয়া ১১টা থেকে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।

সোমবার রাষ্ট্রপক্ষে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণকারী হাকিমদের সাক্ষ্য নেওয়া হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আবু আবদুল্লাহ ভূঞা জানিয়েছেন।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর ৭ অক্টোবরই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিনই আটক করা হয় ১০ জনকে।

আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ কুষ্টিয়া থেকে এসে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন।

এক মাস পর ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।

আসামিদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন। তিন আসামি পলাতক রয়েছেন।

২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর গত ৫ অক্টোবর সোমবার আলোচিত এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

মামলার ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে আবরারের বাবাসহ চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হল।