খুনের দুই মামলা

হারিছ, আনিসের সাজাও মাফ করেছে সরকার

হারিছ, আনিসের সাজাও মাফ করেছে সরকার

আল–জাজিরায় প্রচারিত অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন তথ্যচিত্রে এই দুই ভাইকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দুজনই খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ২০১৯ সালে তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও এত দিন তা গোপন ছিল।

বহুল আলোচিত দুই সহোদর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফ করেছে সরকার। হারিছ দুটি এবং আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল–জাজিরায় প্রচারিত অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন তথ্যচিত্রে এই দুই ভাইকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশেও গতকাল পর্যন্ত সবাই জানত তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য।

জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে তাদের টক শো কনফ্লিক্ট জোনে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে এই দুই পলাতক সহোদরের বাংলাদেশে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই। তাঁদের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফও খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় কারামুক্ত হন তিনি। জোসেফের সাজা মাফ করার জন্য আবেদন করেছিলেন তাঁর মা রেনুজা বেগম। হারিছ ও আনিসের জন্য কে, কখন, কীভাবে আবেদন করেছেন, সে তথ্য এখনো পরিষ্কার হয়নি। জেনারেল আজিজ আহমেদের আরেক ছোট ভাই টিপু আহমেদ ১৯৯৯ সালে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছিলেন।

জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। এর এক মাস আগে ২০১৮ সালের ২৭ মে সাজা মওকুফের পর ছাড়া পান জোসেফ। আর ৯ মাস পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা মাফ করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যে শর্ত মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, যেদিন মন্ত্রণালয় থেকে সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেদিনই ঢাকার পৃথক দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার অনুলিপি পাঠানো হয়। এই দুটি বিচারিক আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছিলেন। আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রজ্ঞাপন পাওয়ার পর হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের নামে থাকা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিনা তামিলে ফেরত পাঠানোর জন্য মোহাম্মদপুর ও কোতোয়ালি থানাকে আদেশ দেন আদালত।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিত, সাজানো ও বানোয়াট মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থদণ্ড ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে মওকুফ করা হয়েছে।

এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, আইনসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয়। পাশাপাশি আসামি হারিছ আহমেদ, আনিস আহমেদ ও তাঁদের মা রেনুজা বেগমকেও প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। সরকারের এতগুলো দপ্তরে প্রায় দুই বছর আগে এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি গেলেও এত দিন তা গোপন ছিল।

হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–৩–এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহবুবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নথিপত্র না দেখে কিছু বলা যাবে না।’ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–৪–এর পিপি আবদুল কাদেরও একই কথা বলেন। এই দুই আদালত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিলেন।

এই সাজা মওকুফের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারও সাজা মওকুফ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।’

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক কোনো ব্যক্তি কখনো কোনো ধরনের আইনি সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার ভোগ করতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় পলাতক কারও সাজা মওকুফ করা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে। এটা আইনের স্পষ্ট বিধান। তিনি বলেন, যদি কেউ এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে সাজা মওকুফের ব্যবস্থা করেন, তাহলে তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধেও আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কারণ, পলাতক আসামির দণ্ড মওকুফ করার অর্থ ক্ষমতার বেআইনি ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সাজা মওকুফের জন্য কোনো আসামিকে উপস্থিত থাকতে হবে, এমন কোনো বাধ্বাযধকতা নেই।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, ‘ওয়ান্টেড (পলাতক)’ আসামির তালিকায় হারিছ আহমেদের নাম আছে।

মোস্তাফিজ খুনের দায়ে সাজা পান হারিছ, আনিস ও জোসেফ

মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানকে ১৯৯৬ সালের ৭ মে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হারিছ আহমেদ, আনিছ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৪ সালের ২৫ মে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জোসেফ ও মাসুদ নামের এক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। আর পলাতক আসামি হারিছ আহমেদ, আনিস আহমেদসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মামলার নথি অনুযায়ী, বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে থাকা জোসেফ হাইকোর্টে আপিল করেন। হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ পলাতক থাকায় তাঁরা আপিলের সুযোগ পাননি। অবশ্য ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুনানি শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে তোফায়েল আহমেদ জোসেফ ও আরেক আসামি কাবিলের সাজা বহাল রাখা হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাসুদ খালাস পান।

হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন জোসেফ ও কাবিল। বর্তমান সরকারের সময় ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর রায় দেন আপিল বিভাগ। তাতে জোসেফের সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়। আর খালাস পান কাবিল। পরের বছর ২০১৬ সালে জোসেফের পক্ষ থেকে তাঁর মা সাজা মওকুফ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতি জোসেফের সাজা মওকুফ করে দেন এবং তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই মামলায়ই ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ হারিছ আহমেদ ও আনিছ আহমেদের সাজা মওকুফ করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।

আবু মোরশেদ খুনের দায়ে হারিছ ও জোসেফের সাজা

১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার জজকোর্ট প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু মোরশেদ। তিনি ছাত্রদল কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন মোরশেদ একটি খুনের মামলায় হাজিরা দিতে জজকোর্টে যান। ঢাকার আইনজীবী ভবনের সামনে তাঁকে গুলি করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাত দিন পর ২ অক্টোবর তিনি মারা যান।

এ ঘটনায় মোরশেদের বাবা আইনজীবী আজিজুল্লাহ ভূঁইয়া কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৯৭ সালের ১১ এপ্রিল হারিছ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ জোসেফসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরের বছর সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও দুজনকে আসামি করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৪ অক্টোবর ১০ আসামির বিচার শুরু হয়। ২০০৩ সালের ১০ আগস্ট মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪–এ পাঠানো হয়।

নথিপত্রে দেখা যায়, শুনানিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় আসামিপক্ষ দাবি করে, নিহত মোরশেদ মোহাম্মদপুরের বাবু খুনের মামলার আসামি। একই মামলায় জোসেফসহ অন্যরা সাক্ষী ছিলেন। শত্রুতা করে তাঁদের মোরশেদ খুনের মামলায় জড়ানো হয়েছে।

তবে ১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন মোরশেদ। তাতে তিনি বলেন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির বাইরের গেটে হারিছ, মামুন, মুন্না, প্যারিস ও শাহীন তাঁকে ঘেরাও করেন। জোসেফ ও মামুন তাঁকে গুলি করেন।

২০০৪ সালের ৩ মার্চ আদালত এ মামলার রায় দেন। তাতে জোসেফ ও তারিক সাইফ ওরফে মামুনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। হারিছ আহমেদ, ইসলাম ওরফে মুন্না, আশানুজ্জামান ওরফে প্যারিস ও শাহীনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান শোহেব, তপন, বাদল ও ফারুক আহমেদ। এই মামলায় আনিস আহমেদ আসামি ছিলেন না।
আদালত রায়ে বলেছেন, নিহতের মৃত্যুকালীন জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য বিবেচনাসহ অন্য সব সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামির সাজা দেওয়া হয়।

এ মামলার রায়ের বিরুদ্ধেও হারিছ আহমেদ কোনো আপিল করেননি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের ২৮ মার্চের প্রজ্ঞাপনে হারিছ আহমেদের এই মামলার সাজাও মাফ করে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এঁদের (হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ) সাজা মওকুফের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। না জেনে কিছু বলতেও পারব না।’ তবে তিনি এও বলেন, ‘আমাদের কাছে একজন যাবজ্জীবন সাজা মাফের আবেদন করেছিলেন। নাম মনে করতে পারছি না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। আরেকজন নিজেকে মানসিক রোগী বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এইটুকুই আমার মনে পড়ছে।’

পলাতক কোনো আসামি কোনো আইনগত অধিকার পেতে পারেন কি না—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো আইনগত অধিকার পলাতক আসামি পায় না। আইনগত অধিকার পেতে হলে তাকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করতে হয়।’-প্রথম আলো