বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছেন শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছেন শিক্ষার্থীরা

দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধের পর ক্যাম্পাসে ফিরছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সোমবার স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের (লেভেল-৪) পরীক্ষা সশরীর শুরু হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারও খুলছে আজ রবিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলবে ৫ অক্টোবর। এখন কেবল হলে উঠবেন স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে ৩০ সেপ্টেম্বর। এ ছাড়া অন্যান্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই অক্টোবর মাসে খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমতি পাওয়ার পর এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সশরীর ক্লাসের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরু হয়েছিল। করোনার সংক্রমণ নিম্নগামী হওয়ায় ১২ সেপ্টেম্বর দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। পরদিন খুলে দেওয়া হয় মেডিকেল কলেজগুলো। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার প্রক্রিয়ায় জোর পায়।

টিকা নিয়ে দেড় বছর পর আবাসিক হলে
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৮ হাজারের কিছু বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল আছে ১৩টি। এর মধ্যে ৯টি ছাত্রদের এবং ৪টি ছাত্রীদের জন্য। দেড় বছর বন্ধের পর গত শুক্রবার হলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এখন কেবল স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষ এবং স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীরা হলে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন।

এই দুই বর্ষে আড়াই হাজারের মতো শিক্ষার্থী আছেন বলে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লুৎফুল হাসান। তিনি বলেন, এসব শিক্ষার্থীর অন্তত প্রথম ডোজ টিকা নেওয়া ছাড়া কাউকেই হলে ওঠানো বা পরীক্ষার অনুমতির সুযোগ নেই। শ্রেণি প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এক মাস ধরে তাঁরা এই প্রচারাভিযান চালান। ফলে প্রায় সবাই প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। অনেকে দ্বিতীয় ডোজ টিকাও নিয়েছেন। এখন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী মাসে তাঁদের হলে ওঠানো হবে।

ঢাবির গ্রন্থাগার খুলছে আজ। বাকৃবির আবাসিক হল খুলেছে, আগামীকাল পরীক্ষা শুরু। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর ক্লাস শুরু হচ্ছে। ইউজিসি লিংকে টিকাসংক্রান্ত তথ্য দিয়েছেন প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী।

কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে। গত শুক্রবার হলে উঠেছেন। করোনার দুই ডোজ টিকাও নিয়েছেন। এক কক্ষে চারটি বিছানায় চারজন থাকেন। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে এলেও হলে উঠেছেন দেড় বছর পর। এটি খুবই স্বস্তির খবর। কারণ, পরীক্ষা থাকায় দুশ্চিন্তায় ছিলেন কবে হলে উঠতে পারবেন। এখন সেই দুশ্চিন্তা কেটেছে।

হলের ফটকে সার্বক্ষণিক মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানালেন শহীদ নাজমুল আহসান হলের প্রাধ্যক্ষ মো. নূরুল হায়দার। তিনি বলেন, আগামীকাল সোমবার স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শুরু হবে। আর স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা এখন চলছে। তাঁদের হলে প্রায় আড়াই শ শিক্ষার্থী আছেন। শিক্ষার্থীরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে হলে থাকছেন। একেকজন একেকটি বিছানায় থাকছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতি
আগের ঘোষণা অনুযায়ী, আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও বিভাগের সেমিনার গ্রন্থাগারগুলো সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা হবে। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ফটক বন্ধ। সামনের অনেক দূর পর্যন্ত দুই দিকে গোলাকার চিহ্ন দেওয়া। শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ করতে পারেন, সে জন্যই এমন ব্যবস্থা।

কলাভবনের নিচতলায় বিভিন্ন বিভাগের বারান্দায় সংস্কারের কাজ চলছে। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে শ্রেণিকক্ষে এখনো তালা ঝুলছে। আবাসিক হলগুলো খুলবে ৫ অক্টোবর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত হলো, যাঁরা অন্তত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন, তাঁরাই গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারবেন এবং হলে উঠতে পারবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, করোনার টিকাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের আগেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এখন গ্রন্থাগারগুলোতে প্রবেশের সময় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যাচাই করে দেখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৩৮ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান জানান, এখন পর্যন্ত করোনার টিকাসংক্রান্ত তথ্য দিয়েছেন সাড়ে ৩১ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী। আর নিবন্ধন করে টিকার জন্য অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী।

বুয়েট
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, বুয়েটে এখন অনলাইনে পরীক্ষা চলছে, যা কাল সোমবার শেষ হবে। এরপর যাঁরা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, তাঁদের জন্য পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। আর বুয়েটের পরবর্তী টার্ম শুরু হওয়ার কথা ৩০ অক্টোবর। ফলে এর আগে সশরীর ক্লাসের সম্ভাবনা নেই।

তবে বুয়েটের একটি সূত্র জানায়, আলোচনা আছে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে প্রথম দিকে শুধু ব্যবহারিক ক্লাস সশরীর নেওয়া যেতে পারে। আর তত্ত্বীয় ক্লাস অনলাইনে নেওয়া যায়। এটি একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হবে।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ রিজেন্ট বোর্ডের জরুরি সভা হয় গতকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কামরুল ইসলাম বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সশরীর ক্লাস শুরু হবে। প্রথমে সপ্তম সেমিস্টার ও স্নাতকোত্তর স্তর এবং ১৮ অক্টোবর দ্বিতীয় ও পঞ্চম সেমিস্টারের সশরীর ক্লাস শুরু হবে।

আবাসিক হলও ৩০ সেপ্টেম্বর খুলবে জানিয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, প্রথম ডোজ টিকার বিষয়টি নিশ্চিত করা সাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ও আবাসিক হলে উঠতে দেওয়া হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টি ৩০ সেপ্টেম্বরের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় চূড়ান্ত হবে। তবে যা মনে হচ্ছে, আসন্ন দুর্গাপূজার পর আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিল এবং ২ অক্টোবর সিন্ডিকেটের সভা ডাকা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও দুর্গাপূজার ছুটির পর খোলা হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীর ক্লাস, পরীক্ষাসহ শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অনুমতির ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কমপক্ষে এক ডোজ করোনার টিকা নেওয়া বা টিকার জন্য নিবন্ধন থাকার শর্ত দিয়েছে ইউজিসি।

জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, এখন সরকার ও ইউজিসির নির্দেশনা মেনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা পরিস্থিতি
দেশের ৫১টি পাবলিক এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ৬ লাখ। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৪৪ লাখ। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী পৌনে ৩০ লাখ।

সরকার ও ইউজিসির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলো, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই শিক্ষার্থীদের অন্তত প্রথম ডোজ করোনার টিকা নেওয়া বা টিকার নিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে তথ্য পেতে ইউজিসি একটি ‘ওয়েবলিংক’ চালু করেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকা শিক্ষার্থীরা জন্মসনদ ব্যবহার করে এখানে টিকার জন্য প্রাথমিক নিবন্ধন করতে পারছেন। আগামীকালের মধ্যে নিবন্ধনের কাজটি শেষ করার কথা।

ইউজিসির ওয়েবলিংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১২টা ২২ মিনিট পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৩৮ জন শিক্ষার্থী তথ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে টিকা নিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। টিকা নেননি প্রায় ৮৪ হাজার শিক্ষার্থী। এ ছাড়া এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করেছেন ৫৩ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষার্থী।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা ইউজিসির লিংকে নিবন্ধন করতে কিছুটা সমস্যায় পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, আলাদা ব্যবস্থায় তাঁদের অধীন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের টিকার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পেরেছেন। কিন্তু এর মধ্যে কতজন টিকা নিতে পেরেছেন, সেই তথ্য তারা এখনো জানতে পারেনি।

দেড় বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন বলেন, টিকা নেওয়া ভালো। তবে মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে।

এমজে/