প্রধান বিচারপতিকে বিদায়ী সংবর্ধনা

প্রধান বিচারপতিকে বিদায়ী সংবর্ধনা

দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবসে বিদায়ী সংবর্ধনা জানিয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। বুধবার আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির বিচারকক্ষে তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হয়।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং শত শত আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রধান বিচারপতির জীবনী পাঠ করে সংবর্ধনা দেন। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সহ-সভাপতি মুহাম্মদ শফিক উল্ল্যাহ সংবর্ধনা দেন। সংবর্ধনার বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে মামলার সংখ্যা বিবেচনায় আমাদের বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। মামলার জট নিরসনে দেশের অধস্তন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারকের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। জেনে খুশি হয়েছি যে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পক্ষ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য।

এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজটি আরো স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা দূরীভূত হবে।

প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি (আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ) অঙ্গের দায়িত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়েছে। তিনটি অঙ্গের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই গণতন্ত্রকে বিকশিত করে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এটা আমাদের সংবিধানের সৌন্দর্য। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস হলো জনগণের আস্থা। এটা হলো বিচারকদের সততা, সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি গণমানুষের অবিচল বিশ্বাস। সাধারণ মানুষের এই আস্থা অর্জনের জন্য বিচারকদের একদিকে যেমন উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্রের অধিকারী হতে হবে, তেমনি সদা বিকাশমান ও পরিবর্তনশীল আইন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এটা অর্জন সম্ভব কেবলমাত্র নিয়মিত অধ্যয়ন ও সময়মতো আইনানুগভাবে বিচারিক কাজ সম্পন্নকরণের মাধ্যমে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদালত কক্ষে আয়োজিত জনাকীর্ণ এই সংবর্ধনায় উভয় বিভাগের বিচারপতিগণ, আ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি মুহাম্মদ শফিক উল্ল্যা বক্তব্য রাখেন। অ্যাটর্নি জেনারেল তার বক্তব্যে বলেন, ‘আপনার প্রদত্ত বিভিন্ন রায় অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আপনার রায়ের গাইডলাইন কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুরক্ষাবর্ম হিসাবে কাজ করছে। নারীর নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার এবং শিক্ষা গ্রহণের পথকে সুগম করছে যা সুদূরপ্রসারীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার বিস্তারে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।’

এছাড়াও ফতোয়ার নামে গ্রামের নিরীহ মানুষকে হয়রানি এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কতিপয় শাস্তি প্রদানের যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছিল আপনার রায়ে এ সকল বিচার বহির্ভূত কার্যকলাপকে আপনি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সেই সাথে এ ধরনের শাস্তি প্রদানকারী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা যাবে বলে রায় প্রদান করেছেন। আপনার সে রায়ের মাধ্যমে গ্রামের নিরীহ মানুষের বিশেষত নারীর প্রতি সহিংসতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অবসরে যাবেন আগামী ৩০ ডিসেম্বর। ওই সময়ে অবকাশকালীন ছুটি থাকায় বুধবার বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস বুধবার তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। কিন্তু তিনি অবসরে যাবেন ৩০শে ডিসেম্বর। ওই দিন দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতির বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হবে। সংবিধান অনুসারে বিচারপতি পদের মেয়াদ ৬৭ বছর পর্যন্ত।

বিচারকের পদের মেয়াদ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো বিচারক সাতষট্টি বৎসর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি রয়েছেন। অন্যরা হলেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বাবা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোস্তফা আলী এবং মা বেগম কাওসার জাহান। বিএসসি ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের পর লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে দু’টি কোর্স সম্পন্ন করা বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ১৯৮৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের ২২ ফ্রেব্রুয়ারি নিয়োগ পান অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে। দুই বছর পর ২০০৩ সালে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। আপিল বিভাগের বিচারপতির দায়িত্বপালনকে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। বঙ্গভবনে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ।