মহাসড়কে বাসে ডাকাতি

‘কলেমা পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল বাচ্চাদের মুখ আর দেখা হলো না’

‘কলেমা পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল বাচ্চাদের মুখ আর দেখা হলো না’

মহাসড়কে ডাকাতির কবল থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন টাঙ্গাইলের আড়াই শ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। গতকাল রোববার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

ফেসবুক পোস্টে শফিকুল লিখেছেন, ‘মহাসড়কে চলাচলকারী একটা বাস ১২ ঘণ্টা ধরে ঢাকা শহরে সারা রাত ঘুরে ডাকাতি করে, কিন্তু ঢাকা সিটির কোনো চেকপোস্ট সেটি থামায় না, বিষয়টা খুবই ভাবনার।‌’ এর পাশাপাশি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া রাতে যাতায়াত না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আরও বলেছেন কাউন্টার ছাড়া কোনো জায়গা থেকে বাসে না উঠতে।

গতকাল সন্ধ্যায় শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘হাত-পা-চোখ সব বেঁধেছিল ওরা। আমার অ্যাজমা আছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হতে ইনহেলার চেয়েছিলাম, দেয়নি। আমি শুধু কলেমা পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাচ্চাদের মুখ আর দেখা হলো না।’

শফিকুল বলেন, গত বৃহস্পতিবার জরুরি প্রয়োজনে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার পর ঢাকা থেকে আর টাঙ্গাইল যাওয়ার বাস নেই। তিনি ও তাঁর বন্ধু আবদুল্লাহপুর যখন পৌঁছান, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে রাজশাহীগামী একটি বাসের চালককে হাত দেখালেও থামেনি। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি বাস দেখতে পেয়ে আবারও হাত দেখান তাঁরা। বাসটি থেমে যায়।

এরপর দুই বন্ধু দ্বিতীয় সারির দুটি আসনে বসেন পাশাপাশি। বাসটা একটু অন্ধকার, কেমন একটু ফাঁকা ফাঁকাও মনে হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করতে বাসচালকের সহকারী বলেন, বেশির ভাগ যাত্রীই ঘুমোচ্ছেন। আরও যাত্রী পথ থেকে উঠবেন। দেড় শ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দুজনেই এরপর গা এলিয়ে দেন।

একজন বললেন, ‘এই বাসের সব ডাকাত’

শফিকুল বলেন, কামারপাড়া পার হওয়ার পর বেশ নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে তাঁদের ওপর সাত থেকে আটজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন গলায় , আরেকজন পেটে ছুরি ধরে তাঁদের। তাঁর বন্ধুকে বাসের পেছনের দিকে নিয়ে যায়। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, চড়থাপ্পড় চলে। একজন বললেন, ‘এই বাসের সব ডাকাত।’

ওই চিকিৎসক বলেন, ‘শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি আত্মসমর্পণ করলাম। ওদের বললাম, যা আছে নিয়ে যান। কোনো ক্ষতি করেন না।‌’

ডাকাত দলের সদস্যরা ওই চিকিৎসকের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোন, দুটি ওয়ালেট, দুটি এটিএম কার্ড, বিকাশ ও কার্ডের পিন নম্বর নেয়। মুঠোফোনটি পাসওয়ার্ড দিয়ে বন্ধ করা ছিল। শফিকুলকে দিয়েই ডাকাত দল মুঠোফোন খুলিয়ে বিকাশ থেকে টাকা নেয়। বারবার তারা জানতে চায়, ব্যাংকে কত টাকা আছে। তিনি (শফিকুল) জবাবে শুধু বলেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত তোলা যাবে। কত টাকা আছে, তিনি মনে করতে পারছেন না।

সবকিছু কেড়ে নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা তাঁদের চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলে। নাইলনের সুতা দিয়ে বেঁধে ফেলায় শফিকুলের হাত দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে টুকরা টুকরা কথা কানে আসছিল শফিকুলের। কেউ কেউ গোঙাচ্ছিলেন। সবকিছু দিয়ে দেওয়ার পরও ডাকাত দলের অত্যাচার শেষ হয় না। একবার শফিকুলের মনে হয় মাথায় কেউ পিস্তল ঠেকিয়েছে, একবার পেটে গুঁতো দেয়।

ডাকাত দলের লোকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল বলেন, তারা একে অন্যকে সাংকেতিক নামে ডাকছিল। কাউকে বেড়াল, আবার কাউকে মাস্টার বলে সম্বোধন করছিল। গাঁজা-ইয়াবাও সেবন করছিল।

শফিকুল বলেন, ভোররাত চারটা সাড়ে চারটার দিকে চন্দ্রার আগে কবিরপুর নামের একটা জায়গায় বেশ কয়েকজন যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে দেয় ওরা। তাঁদের মধ্যে শফিকুলের বন্ধুও ছিলেন। তিনি শফিকুলের স্বজনদের খবর দেন। এবার নতুন করে নির্যাতন শুরু হয়। শফিকুলকে মারতে মারতে পেছনে নিয়ে যায় ডাকাতেরা। তিনি বলেন, সারা রাতে অন্তত ৮০টি থাপ্পড় মেরেছে ডাকাতেরা।

হঠাৎ বাসটি থেমে গেল

বেশ কিছুক্ষণ আর কারও সাড়াশব্দ পাননি শফিকুল। বুঝতে পারলেন বাসটি বেশ অনেকক্ষণ ধরে আর চলছে না। তাঁর ধারণা ছিল হয়তো উত্তরবঙ্গের কোনো জায়গায় চলে এসেছেন। মরবেন কি বাঁচবেন, তা নিয়ে তখনো দ্বিধায় তিনি।

এর মধ্যে একজন এসে তাঁর চোখ ও হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। তিনি নিজেকে বাসচালকের সহকারী বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, তিনি নিজে, বাসচালকও ভুক্তভোগী। ডাকাত দলের লোকজন যাত্রী সেজে তাঁদের বাসে উঠে সেটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল।

শফিকুল জানতে পারেন, যে জায়গাটিতে বাস থেমে আছে, সেটি চট্টগ্রাম রোডের কাছের কোনো একটি জায়গা। বাসচালক তাঁর সহকারীদের বলেন, সবাই মিলে পুলিশের কাছে যাবেন। তিনি বাসটিকে ঘুরিয়ে যাত্রাবাড়ীর দিকে যেতে বলেন, কেননা ওখানে থানা আছে। তাঁরা প্রথমে রাজি হলেও পরে বলেন মামলা করলে বাস থানায় আটকে রাখবে। মালিকের সঙ্গে পরামর্শ না করে এই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে পারবেন না।

যাত্রাবাড়ী পৌঁছে শফিকুল আগে মাতুয়াইলের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথের (আইসিএমএইচ) ঠিকানা জেনে নেন। এখানে একসময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। এক দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে পরিচিত বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন থানায় যাবেন।

থানায় গেলেন, অতঃপর

শফিকুল যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশকে সবকিছু খুলে বলেন। শুনে তাঁরা বলেন, যেহেতু আবদুল্লাহপুর থেকে বাসে উঠেছেন তাই অভিযোগ দিতে হবে সেখানে। শুনে তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় আসেন। সেখান থেকে বলা হয়, যেখানে নেমেছেন অভিযোগ সেখানে দিতে হবে।

শফিকুল বলেন, ‘আমি বুঝলাম, কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। জান নিয়ে ফিরেছি। বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।’

যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক তদন্ত ইয়ামীন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাকাতির অভিযোগ নিয়ে একজন এসেছিলেন। তাঁকে পরামর্শ দিয়ে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি।’ অন্যদিকে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মো আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।

তবে শফিকুল ঘটনা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার পর তাঁর সঙ্গে ভুক্তভোগী আরেক দল যোগাযোগ করে। তারাও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকাগামী অপর একটি বাসে ডাকাতের কবলে পড়ে। সেই বাসও পুলিশ জব্দ করেছে।

হাইওয়ে রেঞ্জের গড়াই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাসটি রাস্তায় পড়ে ছিল, তাঁরা জব্দ করেছেন। মামলা হয়েছে কি না জানেন না।কারণ, হাইওয়ে থানায় মামলা হয় না।-প্রথম আলো