বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন চার কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন চার কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ? এটাও খোলাসা করেছেন ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত এক সাক্ষাৎকারে অন্তত চারটা কারণের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ঢাকায় বৃটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০১৮-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ফরেন এবং কমনওয়েলথ অফিসে ওয়েস্টার্ন বলকান প্রোগ্রামের অতিরিক্ত পরিচালক ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নীতিনির্ধারণের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ওয়াশিংটনে বৃটিশ দূতাবাসের প্রেস অফিসার হিসেবেও অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

রবার্ট ডিকসনের মতে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। মধ্যম আয়ের দেশের জন্য বিশ্ব অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক একটি জায়গা। বাংলাদেশের চমৎকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হবে। প্রয়োজন হবে বিদেশি বিনিয়োগের। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার আগে সবচেয়ে বেশি যার ওপর গুরুত্ব দেন তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তারা প্রথমেই খুঁজেন সুশাসন। তাই আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংস্কার যেমন নিশ্চিত হবে এর পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা পাবে। এ কারণে আগামীর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা তাই মনে করি। অত্যন্ত স্মার্ট, দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক দূতিয়ালীতে পারদর্শী এই কূটনীতিকের মতে, মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলো সভা- সমাবেশ করতে পারে এই বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে বেশি। নির্বাচনের আগে মুক্তভাবে বিতর্ক করার সুযোগ থাকতে হবে। মানুষ যাতে অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টা আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাই মিলে এটা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিকভাবে ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের ওপর জনগণ এবং প্রার্থীদের যেন আস্থা থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ভূমিকা রাখতে হবে। ফলাফল যাই হোক না কেন, মানুষকে সেটা মেনে নিতে হবে। এটাই নির্বাচনের রীতি।

তাকে প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে মূল সমস্যাটা কি?
জবাবে রবার্ট বলেন, অনেক কিছুই বলা যায়। যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দল বয়কট করেছিল। ২০১৮-এর নির্বাচনের সময় আমি ছিলাম না। কিন্তু আমি জানি ওই নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে কড়া অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য কোনো ভূমিকা পালন করবে কিনা? রবার্ট হাসলেন। বললেন, আমরা বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশের জনগণই নির্বাচন করবে। এটা আমাদের কাজ নয়। ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কারিগরি সক্ষমতা রয়েছে। এ নিয়ে আমাদের কোনো প্রেসক্রিপশন দেয়া ঠিক হবে না। তবে ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বন্ধু এবং অংশীদার হিসেবে আমরা মনে করি এখানে গণতন্ত্র অত্যাবশ্যক। আমরা অবশ্যই এই নির্বাচনের ওপর গভীরভাবে নজর রাখবো। ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনগুলোর সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা থাকা অবস্থায় ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা নিয়মিত বৈঠক করতেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। ১৯৯০, ১৯৯৬ এবং ২০০১-এর নির্বাচনে তারা ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বিগত দুটি নির্বাচনে (২০১৪ এবং ২০১৮) কূটনীতিকরা কোনো ভূমিকা রাখেননি। কিন্তু অতি সমপ্রতি শোনা যাচ্ছে, তারা টুয়েসডে গ্রুপের মতো একটি গ্রুপ গঠন করতে চাচ্ছেন। এই সম্পর্কে রবার্ট ডিকসনের জবাব, আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বজুড়েই উদার গণতন্ত্র এবং মূল্যবোধ চ্যালেঞ্জের মুখে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সবার জন্য ‘ওয়েকআপ কল’ হিসেবে কাজ করছে। আমরা কি

গণতন্ত্রকে বেছে নেব নাকি স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদকে বেছে নেব?
আপনার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের কূটনীতিকদের মধ্যে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এটা ঠিক, যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান খুবই আলোচিত। যদিও পাকিস্তানের গল্পটা ভিন্ন। আর শ্রীলঙ্কা ফেঁসে গেছে চীনা ঋণে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান কি? জবাবে বৃটিশ হাইকমিশনার বলেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশ অনেক দিক থেকেই ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের প্রশংসা করতেই হয়। বাংলাদেশের চমৎকার জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি রয়েছে। শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা তেমন নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানকে কাবু করেছে। বাংলাদেশে যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, যে পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে তা ধরে রাখতে বাংলাদেশকে আরও কিছু কাজ করতে হবে। তবে অবশ্যই শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের ফাঁদে যাতে না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ডিকসন সোজাসাপ্টা জবাব দেন। বলেন, আপনাকে বুঝতে হবে চীন ঋণ দিচ্ছে নাকি বিনিয়োগ করছে এবং কী শর্তে করছে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ঋণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। শুধু চীন নয়, জাপানেরও অনেক বিনিয়োগ আছে।

বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি’র সঙ্গেও বাংলাদেশের অনেক ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং একটি উৎসের ওপর নির্ভর না করাই ভালো। আপনি বলছেন যে, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক আছে। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার পটভূমিতে যুক্তরাজ্যের অবস্থান কি?

কিছুটা গম্ভীর, ডিকসন বললেন, সুন্দর প্রশ্ন। চীন এবং ভারত বাংলাদেশের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী। যুক্তরাষ্ট্র খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অতি সমপ্রতি দু’দেশের মধ্যে কয়েকটি বৈঠকও হয়ে গেল। ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কটা যেমন শক্তিশালী তেমনই দু’দেশের মানুষের সম্পর্কও খুব আন্তরিক। তবে আপনার প্রশ্নের জবাবে আসি। অনেক বাংলাদেশির জন্য যুক্তরাজ্য হলো সেকেন্ড হোম। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে কি হচ্ছে তা জানতে বৃটেনের মানুষ খুব উৎসাহী। বৃটিশ পার্লামেন্টও মানবাধিকার পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে খোঁজখবর রাখে। সবদিক থেকেই দু’দেশের সম্পর্ক সোহার্দ্যপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও রবার্ট মতামত দেন এক প্রশ্নের জবাবে। বলেন, আপনি যদি ’৭২-এর সংবিধানের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন যে, সেখানে গণতন্ত্রের কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা আছে। সেই সঙ্গে কথা বলার স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম, ধর্মীয় স্বাধীনতা এসবের প্রতিশ্রুতিও থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যম হচ্ছে আলোকবর্তিকা। ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করে। সুতরাং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয় এমন কিছু গণতন্ত্রের জন্য খারাপ। আমরা ১৪ জন কূটনীতিক গতবছর আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে বৃটেন কীভাবে দেখে? এই প্রশ্নের জবাবে বৃটিশ হাইকমিশনার বলেন, আগেও বলেছি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে এখানে মানবাধিকারের বিষয়টিকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখি। আমেরিকানদের উদ্বেগের কারণটাও আমরা বুঝতে পারি। আমাদের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট প্রতিবছর জুন মাসে প্রকাশিত হয়। আমাদের সর্বশেষ রিপোর্ট পড়লে বোঝা যাবে কোন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিশ্চয়ই, আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবছি। আমাদের এ ব্যাপারে উদ্বেগ রয়েছে।

বাংলাদেশিদের জন্য বৃটেনের তরফে কোনো সুসংবাদ রয়েছে কি? চটজলদি জবাব- হ্যাঁ। বিশেষ করে ইমিগ্রেশন পলিসিতে সুসংবাদ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে যোগ্যতা বিবেচনা করার পন্থা পরিবর্তন করার কথা আমরা ভাবছি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে মানুষকে নিয়োগ দেয়া যাবে। নতুন পয়েন্টসভিত্তিক ব্যবস্থায় পেশাদারদের যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পথ সুগম হবে। শিক্ষার্থীরা এখন পড়াশোনা শেষে দু’বছরের জন্য চাকরি করতে পারবে।-মানবজমিন