সৌদিগামীদের অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতেই দুই বছর পার

সৌদিগামীদের অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতেই দুই বছর পার

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে শ্রমিক যাওয়ার হার বাড়লেও কোনোমতেই অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করাতে পারছে না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি ব্যুরো। সরকারের বেঁধে দেয়া অভিবাসন ব্যয়ের দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা খরচ করেই শ্রমিকরা দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় হওয়ার কারণে একজন শ্রমিকের বিদেশে যাওয়ার খরচের টাকা তুলতেই অন্তত দুই থেকে আড়াই বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এতে একজন শ্রমিক যে পরিমাণ টাকা খরচ করে বিদেশ যাচ্ছে সেই পরিমাণ টাকা (রিটার্ন) দুই বছর সময়েও আসছে না বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

কিভাবে সৌদিগামী শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় কমানো (নিয়ন্ত্রণে) যায় তা নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর জনশক্তি ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি আরো বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। নতুবা লাখ লাখ শ্রমিক দেশ থেকে গেলেও অর্থনৈতিকভাবে কর্মী বা দেশের কোনো উপকার হচ্ছে না বলে মনে করছেন এই সেক্টরের সাথে সম্পৃক্ত অভিবাসন বিশ্লেষকরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার জনশক্তি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের মধ্যে একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া আর কোনো দেশেই সেই গতিতে কর্মী পাঠাতে পারছে না মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়া এখনো বন্ধ। যদিও এই দেশটিতে এখনো প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা আছে। তারা বলেন, শুধু ভিসা ট্রেডিংয়ের কারণে সৌদি আরব যেতে একজন শ্রমিককে এখনো (দালাল নির্ভর) সাড়ে চার লাখ টাকা থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একজন কর্মী সৌদি আরব গিয়ে বেতন পাচ্ছে ৮০০ রিয়াল থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ রিয়াল। যা বাংলাদেশী টাকায় সর্বোচ্চ ২০-২৭ হাজার টাকা পর্যন্ত।

এই বেতনে কাজ করার জন্য একজন শ্রমিকের দেশ থেকেই শুধু অভিবাসন খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত এক লাখ ৬৫ হাজার টাকার দ্বিগুণেরও বেশি টাকা। আবার কখনো সেটি তিনগুণও হয়। এই অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতে শ্রমিককে অন্ততপক্ষে দুই বছর সেখানকার কোম্পানিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। এর মধ্যে আবার থাকা খাওয়ার খরচও আছে। তারা বলছেন, সৌদি আরবে শুধু বেশি শ্রমিক যাচ্ছে, এটা দেখলেই চলবে না। সেখান থেকে শ্রমিকদের কাছ থেকে কী পরিমাণ রিটার্ন আসছে, সেই হিসাবটাও মিলাতে হবে। তাদের মতে, দুই বছরে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স সৌদি আরব থেকে শ্রমিকরা পাঠাচ্ছেন ওই পরিমাণ টাকা শ্রমিকরা যাওয়ার সময় দেশেই ভিসা কেনা, প্রসেসিং, বিমান টিকিটসহ অন্যান্য খাতে খরচ করছেন। তাই এই সেক্টরে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা মনে করছেন। নতুবা বিদেশগামী কর্মী যাওয়ার শুধু সংখ্যা বিএমইটি তাদের পরিসংখ্যানের ঘরে যোগ করে বাড়ানো দেখাতে পারবেন। বাস্তবিক অর্থে ফিটব্যাক কিন্তু শূন্যে! যদিও সৌদি আরবে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি থেকে ভাঙ্গারি সংগ্রহ করে উপরি আয়ের ব্যবস্থা আছে শোনা যায়।

ঈদের আগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে আসা সৌদিগামী দুজন শ্রমিক রতন ও বশিরের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, তাদের দুজনের জন্যই সৌদি আরবে থাকা তাদের চাচা দুটি ভিসা কিনে পাঠিয়েছেন। এখন প্রসেসিং করার জন্য তারা বিএমইটিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট করাতে এসেছেন। বিদেশ যেতে একজনের কত টাকা খরচ হচ্ছে জানতে চাইলে রতন অকপটে বলেন, আমার চাচা ভিসাসহ চার লাখ টাকা খরচ লাগবে বলে আমাদের জানিয়েছে। এখন আমাদের যাওয়া দরকার। লোকের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে তারা প্রবাসী কল্যাণ ভবনের নীচতলায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেকশনে ব্যাংক ড্রাফটসহ আবেদন জমা দিতে যান। যদিও তাদের দুজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ঢাকা বিভাগের আওতার মধ্যে পড়েনি। তবুও ‘সিস্টেম’ করে তারা জমা দিয়েছেন বলে জানান।

সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত বোরহান উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরবে শ্রমিকের চাহিদা প্রচুর থাকলেও সেভাবে ওই দেশে থাকা শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হচ্ছে না। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার আগে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকায় কর্মী পাঠানো হচ্ছে এমন একটি অঙ্গীকারনামা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে নিচ্ছে। কিন্তু এজেন্সিগুলো সেই হিসাবে দুই তিনগুণ বেশি টাকা নিচ্ছে বলে তার অভিযোগ।

অভিবাসন ব্যয় কমাতে সরকারের করণীয় কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিবাসন ব্যয় কমাতে হলে অবশ্যই সৌদি আরবে গিয়ে যারা ভিসা বেচাকেনার সাথে জড়িত তাদের শনাক্ত করে ভিসা ট্রেডিং করা বন্ধ করতে হবে। একই সাথে ভিসা প্রসেসিং খরচ কমাতে হবে। এর মধ্যে বিমান টিকিটের দাম তো অবশ্যই কমাতে হবে। তার মতে, কারা শ্রমিক পাঠাতে বেশি টাকা নিচ্ছে তাদের নিজস্ব কৌশলে শনাক্তের পর লাইসেন্সের কার্যক্রম স্থগিতসহ নানাভাবে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সৌদি আরবে অনেক কর্মী যাওয়ার পর আকামা না হওয়ার কারণে কোম্পানি থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। পরে ওই সব কর্মী অবৈধভাবে অন্যত্র কাজ করে। যার দরুন আগের কোম্পানির মালিক তাদের কোম্পানির নামের হুরুপ (ডিক্লারেশন) বাতিল করে দেয়।

এর ফলে অনেকে আকামা করাতে না পেরে দেশে ফেরত চলে আসতে বাধ্য হয়। এসব ঘটনার কারণে এজেন্সি মালিকদের থাকতে হয় সবসময় আতঙ্কে। এর জন্য দূতাবাসের সংশ্লিষ্টদের মনিটরিং জোরদার করার পাশাপাশি শ্রমিকদের সমস্যা দেখার জন্য দূতাবাসে আরো জনবল বাড়াতে হবে। যাতে সমস্যায় পড়া লোকগুলোকে যেন দ্রুত সেবা দেয়া যায়।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানু, ফেব্রু ও মার্চ) বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ করা হয়েছে তিন লাখ ২২ হাজার ৫৮৩ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গিয়েছে দুই লাখ ছয় হাজার ৫৭ জন শ্রমিক। তার মধ্যে মার্চ মাসে গিয়েছে ৭৮ হাজার ৮৭০ জন। এর মধ্যে মহিলা শ্রমিক রয়েছে ছয় হাজার ৬১৩ জন। সেই হিসাবে ৭২ হাজার ২৫৭ জন শ্রমিক সৌদি আরব গিয়েছে। এই কর্মীদের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে।

অভিসান বিশ্লেষকরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ অভিবাসন ব্যয় করে বিদেশ যাওয়ার চেয়ে ওই টাকা দিয়ে দেশে ছোটখাটো ব্যবসা করাই অনেক শ্রেয়। তবে হ্যাঁ, যদি অভিবাসন ব্যয় (নিয়ন্ত্রণের মধ্যে) কমিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়, তাহলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি কর্তৃপক্ষ সেক্ষেত্রে ক্রেডিট নিতে পারেন। নতুবা বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের হিসাবে শুধু শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যাই বাড়ানো দেখানো যাবে। সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি রিজার্ভের গতি কিন্তু মোটেও সেই তুলনায় (অভিবাসন) বাড়ছে না। এটি এখন ভাবতে হবে।

এসব বিষয়ের উত্তর জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ২টা ৫৬ মিনিটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমদ মনিরুছ সালেহিনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি টেলিফোন রিসিভ করেননি।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশটিতে ২০ লাখেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক নারী শ্রমিক রয়েছে।