ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে ঢাকাও

ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে ঢাকাও

বৃষ্টি নামলেই ঢাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে নগর জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও সমাধান হচ্ছে না। এজন্য সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে দেড় বছর আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে দায়িত্ব ছাড়ে ঢাকা ওয়াসা। সমন্বয়হীনতা কাটাতে দায়িত্বে আসে দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দায়িত্ব পেয়েও গত বছর জলাবদ্ধতার নিরসন হয়নি। এবারো জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছে সংস্থা দুটি। এ জন্য ১৭৮টি সম্ভাব্য জলাবদ্ধপ্রবণ স্পট শনাক্ত করা হয়েছে এরই মধ্যে অধিকাংশ স্পটের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো চলমান আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরেও নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হবে। সিটি করপোরেশন ১৭৮টি স্পট শনাক্ত করলেও বাস্তবে এর সংখ্যা অনেক বেশি। যেসব স্থানে সংস্কার কাজ করা হয়েছে, সেসব স্থানেই অসংখ্য খানাখন্দ রয়েছে। নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির হিড়িক পড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কোনো সংস্থা কাজ শেষ করছে না। আর এটাই হবে এবছর জলাবদ্ধতা সৃষ্টির বড় কারণ। তারা বলেন, রাস্তা সংস্কারের নামে উঁচু করা হচ্ছে। ফলে বাসা বাড়ির পানি নামতে পারছে না। দুই সিটি করপোরেশনেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। গত বছরের ২রা জানুয়ারি থেকে ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও খাল পরিষ্কারে নামে দুই সিটি। যদিও প্রথম ৬ মাস নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে তা থমকে যায়। ফলে গেল বর্ষায়ও নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তখন সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বন্ধ নর্দমা, সরু নালা ও বর্জ্য জমায় পানি খালে পৌঁছতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, ঢাকায় বৃষ্টি হলে সেই পানি নর্দমা কিংবা ড্রেনে যায়। কয়েক ধাপে খালের মাধ্যমে নদীতে যায়। নদীতে যাওয়ার আগে বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্পটে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়। পানি খালে যেতে সময় লাগে। পানির চাপ বাড়লে অনেক সময় এসব স্পট ডুবে যায়। বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ডুবে যায়। এতে গণপরিবহনসহ নগরবাসী বিপাকে পড়েন। রাজধানীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির হয় এমন ১৭৮টি জায়গা শনাক্ত করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এসব জায়গায় পানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে প্রতি বছর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো স্থানে বৃষ্টি ছাড়াই বছরব্যাপী জলাবদ্ধতা দেখা যায়। ফলে আসন্ন বর্ষায় এসব জায়গায় পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা করে সংস্কার কাজ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। এবার রাজধানীর জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি ১৩৬ স্থান শনাক্ত করে। এর মধ্যে ৭০টিরও বেশি স্থানের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু অংশের কাজ চলছে, আবার কিছু অংশের কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও খাল পরিষ্কারের কার্যক্রম চলছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত বছর ডিএনসিসি এলাকায় জলাবদ্ধপ্রবণ ১০৩টি স্থান শনাক্ত করেছে করপোরেশন। এ বছর ৬১টি জলাবদ্ধপ্রবণ স্থান সংস্কার করা হয়েছে। বাকি ৪২টি স্পটের সংস্কারের কার্যক্রম চলছে।

ডিএনসিসি শনাক্ত করা স্পটগুলো হচ্ছে- মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের রোড ৩ থেকে ৪ পর্যন্ত, রোড ৬, রহিম ব্যাপারী ঘাটের উত্তর পাশ, দক্ষিণ পাশ, মোহাম্মদিয়া হোমস লিমিটেডের সামনে, আদাবর সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর অফিসের সামনে, অফিসের বিপরীত পাশে, কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনের জলাধারের পূর্বপাশ, উত্তর-পশ্চিম পাশ, ইস্টার্ন হাউজিংয়ে জি ব্লক রোড নং ২-এর মাথা থেকে বাইতুল ইবাদাহ জামে মসজিদ পর্যন্ত, প্লট নং কে ৭ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সামনে, এল ব্লক বকুল তলা, হোটেল সংলগ্ন, কালসি স্টিল ব্রিজের উত্তর পাশ, এসটিএস থেকে পলাশনগর সবুজবাংলা নতুন ব্রিজ, প্যারিস রোড খালের ডি ব্লক, মিরপুর ১০, ঝুটপট্টি, এভিনিউ ৫, সি ব্লক, মিরপুর ১১, মদিনা নগর এভিনিউ ৫, সি ব্লক, রামপুরা ব্লক এ, রোড ৯, বাড়ি নং- ৬/বি/১, দক্ষিণ বিশিল, তৃতীয় কলোনি, বাড়ি-৬৫/৪/এ, পঙ্গু হাসপাতাল সংলগ্ন পূর্বপাশ, কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনের জলাধার, আবদুল্লাহপুর স্লুইস গেট থেকে উত্তর থানা ব্রিজ পর্যন্ত, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর থেকে চণ্ডালভোগ ব্রিজ পর্যন্ত, ফুলবাড়িয়া টেকপাড়া থেকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত, আনন্দবাজার থেকে ভাঙা ব্রিজ, বাঁশেরপুল হাবিবুল্লাহ রোডের সামনে, দিগন্ত পেট্রোল পাম্প থেকে কালশী স্ট্রিল ব্রিজ, কালশী রোড ব্রিজ থেকে দক্ষিণ দিকে, মসজিদুল জুমা কমপ্লেক্স থেকে কালশী মেইন রোড, কালশী ব্রিজের উত্তর পাশে কাঁচা রাস্তার কর্নারে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবনের পশ্চিম পাশ, ঢাকা রিয়েল এস্টেটের পুরনো দুটি কালভার্টের নিচে এবং কাদিরাবাদ হাউজিং রোড ২, ৫ ও ৬।

এসব স্পটের কারণে এবারো জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গুলবাগ, মৌচাক মোড়, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজার, পোস্তগোলা করিমুল্লাহবাগ থেকে শ্মশানঘাট পর্যন্ত, শ্যামপুর শিল্প এলাকার ১০, ২০, ২২ ও ২৩ নম্বর রোড, দক্ষিণ দনিয়া মিনাবাগ, পাটেরবাগ সড়ক, বায়তুল জান্নাত মসজিদ সড়কসহ বেশকিছু স্থানের সংস্কার কাজ চলছে। ঢালকানগর এলাকা, আলমগঞ্জ রোড, নর্থ ব্রুক হল লেন, পাতলা খান লেন, মায়াকানন, মুগদা হাসপাতালের সামনে, নয়াপল্টন, ফকিরাপুলের বক্স কালভার্ট রোড, পল্টন মডেল থানার সামনে, সোবহানবাগের তল্লাবাগ, নারিকেলবাড়ি, ইগলুর গলি জলাবদ্ধপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত হলেও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। নর্দমার মুখগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। কালভার্ট ও খাল আমরা পরিষ্কার করেছি। ভূগর্ভস্থ যে নর্দমা রয়েছে সেগুলো আমরা পরিষ্কার করেছি। আমরা আশাবাদী অতিবৃষ্টি হলেও ইনশাআল্লাহ ঢাকাবাসীকে আধাঘণ্টার মধ্যেই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হবো।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে এমন ৪২টি স্থান আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে জলাবদ্ধতা হতে পারে। এসব এলাকায় এখনো কাজ শুরু হয়নি। জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলের জন্য ১০টি র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠন করা হবে। যারা অঞ্চলভিত্তিক সমস্যা সমাধানে দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। এই টিম আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে গঠন করা হবে। আশা করি, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার জলাবদ্ধতা অনেক কম হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দায়িত্ব পেয়ে সিটি করপোরেশন অনেকগুলো খাল উদ্ধার করেছে। এখনো অনেক খালের নেটওয়ার্ক শনাক্ত হয়নি। ফলে জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছে। মেয়ররা যা করেছেন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে তাদেরকে এ বিষয়ে আরও বেশি নজরদারি বাড়ানো উচিত। উদ্ধার হওয়া কিছু খালে পানির ধারণক্ষমতা বেড়েছে। আবার কিছু খালের ধারণক্ষমতা নেই। উদ্ধারকৃত সেই খালগুলো জনসচেতনতার অভাবে স্থানীয়রা দখল করে ফেলছে। ময়লা আবর্জনা ফেলে পানির প্রবাহ আটকিয়ে দিয়েছে। খালের সঙ্গে ড্রেনের সংযোগ নেই। কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন করতে সারা বছরব্যাপী নজরদারি বাড়াতে হবে। স্থানীয় কাউন্সিলর ও সচেতন মানুষকে নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বর্ষা শুরুর আগেই খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার করে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় কোনো সুফল আসবে না।