সুনামগঞ্জে পানিবন্দি ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ

সুনামগঞ্জে পানিবন্দি ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ

সুনামগঞ্জবাসী ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। জেলার তিনটি উপজেলার শতভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। অন্যান্য উপজেলারও ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি। আবার ক্রমেই বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।

হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট বন্ধ থাকায় খাদ্য সংকটেও পড়েছে মানুষজন। বৃষ্টির পানিই খাবার পানি হিসেবে লাখো মানুষের শেষ ভরসা। সড়কে গলা থেকে ডুব সমান পানি। তিন দিন হয় বিদ্যুৎ নেই কোথাও। এক তলা বাড়িতে থাকার কোনো উপায় নেই।

শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ শহরতলির হাছনবাহারে গিয়ে দেখা গেছে, ২০০ পরিবারের একটিও গ্রামে নেই। গ্রামের বেশির ভাগ ঘরের চাল ছুঁয়েছে পানি। গ্রামের সবাই শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।

গ্রামের প্রবীণ চান মিয়া ও ফিরোজ আলীকে গ্রামের পথে নৌকা দিয়ে শহরে আসতে দেখা যায়। তারা দুজনেই জানালেন, এমন ভয়াবহ বন্যা বা দুর্যোগ এর আগে কখনও দেখেননি। এই দুইজন আরও জানালেন, গ্রামের কেউ গৃহপালিত গরু ও অন্য প্রাণীর বা আসবাবপত্র নিয়ে চিন্তা করছে না। সবাই প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়ের খোঁজে শহরের দিকে যাচ্ছেন। শহরতলি এবং শহরের বানভাসি মানুষ দুই তলা ও বহুতল ভবনের তালা ভেঙেও ভেতরে ঢুকছেন।

শুকনো খাবার বা কোনো প্রকারের খাবারই পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানপাট বন্ধ। কোনো দোকান খোলা দেখলেই বানভাসি অসংখ্য মানুষ গিয়ে ভিড় করছেন। দোকানের মালামাল কেউ কেউ টাকা-পয়সা দিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়ের জন্য নৌকা দেখলেই চিৎকার করে ডাকছেন। ছোট ছোট বারকি নৌকা নিয়ে ঝগড়াঝাটি, মারপিটও হচ্ছে।

আশ্রয় কেন্দ্রে যারা উঠেছেন, তারাও অনেকটা অনাহারে আছেন। শহরের উকিল পাড়ার বেনু দাস ও নির্মলা দাসের ঘরে গলা সমান পানি। তারা সরকারি জুবিলী স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। বেনু দাস জানালেন, শুক্রবার রাতে সামান্য কটা চিড়া ও গুড় খেয়েছিলেন। এরপর শনিবার বিকেল পর্যন্ত কিছুই খাওয়া হয়নি তাদের।

শনিবার দুপুরে কালেক্টরেটের দুতলায় আশ্রয় নেওয়া বানভাসীদের মধ্যে দুই হাজার প্যাকেট খাবার নিয়ে বিতরণ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছিলেন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। পরে অন্যদের দায়িত্ব দিয়ে ওখান থেকে ফিরে আসেন তিনি।

দুপুর ১টায় শহরের মল্লিকপুর সড়কে অন্তঃসত্ত্বা এক গৃহবধূ প্রসব যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলেন। পরে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অসীম চন্দ্র বণিক একটি বারকি নৌকায় করে গিয়ে ওই গৃহবধূকে উদ্ধার করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুতলায় নিয়ে আসেন।

অনেক চেষ্টা করেও কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। দুপুর ২টায় জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষেই সন্তান প্রসব করেন ওই গৃহবধূ।

বিকেল সাড়ে ৫টায় সার্কিট হাউসের সামনের সড়কে কোমর সমান পানিতে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ রুজিনাকে নিয়ে স্বামী আবু সাঈদ নিরাপদ আশ্রয়ের যাওয়ার জন্য নৌকা খুঁজছিলেন। দীর্ঘক্ষণ পরেও তারা নৌকা পাননি।

জেলা প্রশাসক বিকেল ৬টায় জানান, সুনামগঞ্জে শুকনো খাবারসহ কোনো খাবারই পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সিলেট থেকে লঞ্চ যোগে চিড়া, মুড়ি, মোমবাতি, গুড়সহ শুকনো খাবার নিয়ে আসা হচ্ছে। মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ থেকেও জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে শুকনো খাবার আসছে।

বানভাসি মানুষকে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনীর ৩০টি উদ্ধারকারী নৌযান এবং নৌবাহিনীর আরও কিছু উদ্ধারকারী যানসহ সুনামগঞ্জের দিকে রওনা দিয়েছে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর দল।

রোববার সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা কাজ শুরু করবেন। এসময় ব্যক্তি পর্যায়েও ধনাঢ্যদের বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান জেলা প্রশাসক। অনেকে এ ডাকে সাড়া দিচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

গত ১০ দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ঢলে সুনামগঞ্জে দ্রুত পানি বাড়তে থাকে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার বিকেলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। শুক্রবার ভোররাতে এক ঘণ্টার মধ্যে পানি চার থেকে পাঁচ ফুট বেড়ে যায় এবং ভয়াবহ বন্যা বিপর্যয় দেখা দেয়।