মহাদুর্ভোগে বানভাসিরা

মহাদুর্ভোগে বানভাসিরা

দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির দুর্ভোগ আরো দীর্ঘ হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। টানা ভারী বর্ষণের সাথে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি সিলেট, সুনামগঞ্জকে ডুবিয়ে এখন নেত্রকোনা জেলাজুড়ে জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে দেশের প্রধান সব নদনদীর পানিও বাড়ছে। অনেক জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় নদনদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভাঙনের তাণ্ডবও শুরু হয়েছে। এ দিকে সারা দেশের বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রায় অর্ধকোটি বানভাসী মানুষ রয়েছে মহাদুর্ভোগে। ঘরবাড়ি থেকেও নিজের বসতভিটায় বসবাসের উপায় নেই। আশ্রয় নেই, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। লাখ লাখ নারী পুরুষ ও শিশুর দুর্দশা দেখারও বোধহয় কেউ নেই। আশ্রয়কেন্দ্রেও খাদ্যসহ নানা সঙ্কট। আক্রান্ত এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের বাইরে। এ এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি। কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা অনিশ্চিত। এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে জমির ফসলসহ সব অবকাঠামো।

এ দিকে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সারা দেশে বন্যা উপদ্রুত এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনিস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম গতকাল সংবাদমাধ্যমকে এসব কথা জানান। তিনি বলেন, সোমবারের পর থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে পারে। তবে বর্তমানে তা বিপদসীমা অতিক্রম করে রেকর্ড লেভেলে রয়েছে। এ জন্য পানি সম্পূর্ণ নামতে এক সপ্তাহ লাগতে পারে। তিনি বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। সুনামগঞ্জে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টির পানি নামবে। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট ডিভিশনে অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র মতে, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের স্থানগুলোয় মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা,গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদনদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

নেত্রকোনায় সেনা মোতায়েন
ঢলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় পানিবন্দীদের উদ্ধার ও সহায়তার জন্য রোববার সকাল থেকে খালিয়াজুরিতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তারা এখন সম্মিলিতভাবে পানিবন্দীদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন।

এ দিকে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যার পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন নেত্রকোনার ১০ উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা ও সুসং দুর্গাপুর উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলায় অন্তত পাঁচ লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ পর্যন্ত ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে কমপক্ষে ২১ হাজার বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি নদী মোমেশ^রী, গনেশ্বরী, উব্দাখালী মঙ্গলশ্রী, মহাদেও, কংশ, ধনু ও মগড়া নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেটে আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্যসঙ্কট
বন্যায় ভাসছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। এ দুই জেলার অর্ধেক এলাকা এখনো অন্ধকারে। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আটকেপড়া মানুষজন পড়েছেন মহাবিপদে। পানিবন্দী থেকে জীবনযাপন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। তবে গতকাল থেকে সিলেটে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি নগরীর আশপাশ এলাকায় পানি কমেছে। শুক্রবার থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ার পর সিলেট সিটি করপোরেশন ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বা বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট। আশ্রয়কেন্দ্র খুললেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। নগরীর ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলার কথা জানালেও সেখানে কী পরিমাণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন; তাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ ও পরিবহন) মো: রুহুল আলম। কেবল সিলেট নগরেই নয়, জেলার অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রেরও একই অবস্থা। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, গত বুধবার থেকে সিলেটে এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়। এর মধ্যেও পর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতা চালাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিকেও তারা পাশে পাচ্ছে না।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: আনোয়ার সাদাত জানান, জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নৌকার সঙ্কটে এসব ত্রাণ পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, জেলায় মোট ৩৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০টি কেন্দ্রের তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে রয়েছে। সে হিসাবে ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ হাজার ৮৪৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে বন্যায় নৌকা ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। নৌকা নিয়ে স্বজনরা আটকেপড়াদের তীব্র স্রোতের মধ্যে নিরাপদে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুই ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া চাওয়া হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। গোয়াইনঘাটের মোতালিব নামের এক ব্যক্তি জানান, সকালে তিনি ৩৫ হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের তিন দিন পর উদ্ধার করেছেন। উদ্ধারকাজে নৌকার সঙ্কট চলছে। সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ নিজেদের স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন।

গোলাপগঞ্জে হাজারো মানুষ পানিবন্দী
গোলাপগঞ্জে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টি কিছুটা থামলেও সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সুরমা নদীর বাঁধ ভেঙে প্রতিদিন পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধিতে নতুন নতুনভাবে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি বৃৃদ্ধির ফলে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

ওসমানীনগরে তলিয়ে গেছে সব কয়টি গ্রাম
তলিয়ে গেছে ওসমানীনগর উপজেলার প্রায় সব কয়টি গ্রাম। উপজেলার আট ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের মানুষের বসতঘরে উঠেছে বানের পানি। হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, কবরস্থান রয়েছে পানির নিচে। উপজেলা সদরের সাথে সংযুক্ত সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গেলে নৌকাই এখন একমাত্র চলার বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপজেলায় ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

শেরপুরে পানিবন্দী ৪০ গ্রামের মানুষ
জেলার সীমান্তবর্তী তিন উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সেই সাথে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এতে করে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত ৪০ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গবাদিপশু, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্লাবিত এলাকার মানুষ। অনেক এলাকায় এখনো বাড়িঘরে রান্নার চুলা জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি তাদের ঘরে শুকনো খাবার পর্যন্ত নেই। ওই সব অসহায় মানুষ বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওই সব এলাকায় দুর্ভোগ বাড়লেও চিকিৎসাসেবা ও ত্রাণতৎপরতা পৌঁছেনি বলে বিস্তর অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এ দিকে গত দুই দিন শেরপুরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উজানের পানি দ্রুতই নেমে যাওয়ায় পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে নতুন করে আবারো নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়বে। জেলার সব নদনদীতে পানি কমলেও ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

ছাতকে ৩ জনের লাশ উদ্ধার
ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় প্রায় এক ফুট পানি কমেছে। গতকাল ছাতকের জাউয়া বাজার ও মাধবপুর এলাকায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ শিশু হানিফা (৬) ও খালেদ আহমদের (২৬) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল সকালে বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলার মুক্তিরগাঁও গ্রামের ব্যবসায়ী ইজাজুল হক রনির ছেলে তমালের (৫) মৃত্যু হয়েছে। চার দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় চরম দুর্ভোগে লাখ লাখ বানভাসী মানুষ। দুর্গত এলাকায় মারাত্মক খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখনো সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণের খবর পাওয়া যায়নি।

রাজনগরে ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী
রাজনগরে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার উত্তরভাগ, ফতেহপুর, কামারচাক, টেংরা ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। জানা গেছে, মনু ও কুশিয়ারা নদীর উজানে ভারতের আসাম, ধর্মনগর, কৈলাশহরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রবল বর্ষণ ও নেমে আসা ঢলে রাজনগরে মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শ্রীমঙ্গলস্থ মৌলভীবাজার আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৩৩.২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। মনু নদীর আদিনাবাদ এলাকা ও কুশিয়ারা নদীর আবদুল্লাহপুর নামক স্থানে ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। কুশিয়ারা প্রতিরক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।

দিনাজপুরে ৩ নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই
দিনাজপুরে ছোট-বড় ১৯টি নদনদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার আত্রাই, পুনর্ভবা ও ছোট যমুনার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। বৃষ্টি হলে এ তিন নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আগামী ৭২ ঘণ্টায় জেলায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।

কয়েক দিন ধরে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুক্রবার হতে দিনাজপুরে ভারী বৃষ্টিপাতে নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বৃষ্টির প্রভাবে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেও গতকাল বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভেয়ার মাহাবুব আলম জানান, জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া আত্রাই, পুনর্ভবা ও ছোট যমুনার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জেলার কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিস্তা আবারো বিপদসীমার ওপরে
তিস্তা নদীর পানি আবারো হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। রোববার সকাল ৬টা থেকে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান শনিবার বিকেল থেকে তিস্তার পানি বাড়তে থাকে এবং রোববার ৬টা থেকে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর পর থেকে পানি কমতে থাকে। সকাল ৯টায় পানি কমে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং দুপুর ১২টায় বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তার পানি। এ দিকে পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। শনিবার রাত থেকে তিস্তার পানি হু হু করে বাড়তে থাকায় আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কেটেছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর মানুষজনের। তিস্তা নদীঘেঁষা গ্রামগুলোতে পানি উঠেছে বলে জানা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আসাফউদ দৌলা জানান, শনিবার তিস্তার পানি কিছুটা কমলে উজানের ঢলে রোববার আবারো বেড়েছে পানি।

গাইবান্ধায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকায় পানি আরো বেড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। তিস্তা নদীর ভাঙনে শত শত পরিবার গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের মানুষের বসতভিটাসহ ফসলি জমি। ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়নের ডাকুয়া চরের বদিউজ্জামান জানান, গত দুই থেকে যমুনার নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকের বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে গেছে। এ ইউনিয়ন সম্পূর্ণ চর হওয়ার কারণে আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে লোকজন গাইবান্ধা জেলা ও জামালপুর জেলা শহরের উঁচু জায়গায় আশ্রয়ের জন্য ছুটছে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার পানি বর্তমানে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার হরিপুর, শ্রীপুর চণ্ডিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র হয়েছে ভাঙন।

নাগেশ্বরীতে পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ
নাগেশ্বরীতে ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা। কেউ কেউ বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে অন্যত্র। বেরুবাড়ী ইউনিয়নের স্লুইসগেটসংলগ্ন ইসলামপুর, বামনডাঙ্গার মালিয়ানী ও নামাহাইল্যায় পাগলাকুড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে তিন দিন ধরে হু হু শব্দে প্রবেশ করছে পানি। তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেখানে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ছবির মতো ভাসছে ঘরবাড়ি। তলিয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট তীব্র স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে নদী পাড়ের কিছু ঘরবাড়ি। নুনখাওয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রাশেদুল ইসলাম জানান, বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন পূর্ব কাপনায় দুই শতাধিক ঘরবাড়ি। এরই মধ্যে বামনডাঙ্গা, বেরুবাড়ী, রায়গঞ্জ, কালীগঞ্জ, কচাকাটা, কেদার, বল্লভেরখাস, নুনখাওয়া, নারায়ণপুর ইউনিয়ন প্রায় সম্পূর্ণ ও পৌরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড প্লাবিত। এখানে ২৫ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে অসহায় দিন কাটাচ্ছেন।

ইসলামপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ওপরে
ইসলামপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রসহ সব ক’টি নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু বাড়িঘরে এখনো পানি প্রবেশ করেনি। ডুবে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা। আবহাওয়া অধিদফতরের সূত্র মতে, আগামী দুই দিন যমুনা- ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

তলিয়ে যাচ্ছে চিলমারীর অনেক এলাকা
কুড়িগ্রামের প্রধান নদনদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। বিশেষ করে চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্নাঞ্চল, দ্বীপচর ও নদনদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ার ফলে এরই মধ্যে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে পাট, আউশ, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলি জমি। টানা বৃষ্টির ফলে বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্রের তীব্র স্রোতে ভেঙে গেছে বেশ কিছু এলাকার রাস্তাঘাট। হুমকির মুখে রয়েছে ডান তীর রক্ষা প্রকল্প।