অদূরদর্শী জ্বালানি পরিকল্পনা: দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চাপে থাকবে দেশের অর্থনীতি

অদূরদর্শী জ্বালানি পরিকল্পনা: দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চাপে থাকবে দেশের অর্থনীতি

বিপর্যয়ে দেশের জ্বালানি খাত। দেখা দিয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শেল অয়েলের মালিকানায় থাকা পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র ক্রয়ের মাধ্যমে দেশের গ্যাস খাতের নিজস্ব ভিত্তি তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনে দূরদর্শিতার অভাবে সংকট ঘনীভূত হয়েছে অনেক বেশি।

দেশে গত অর্থবছরে গ্যাসের মোট চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ পূরণ করতে হয়েছে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। আমদানিতে প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির গড় দাম পড়েছে ২৫ ডলার। গ্যাস খাতে মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় নয় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে (১ মিলিয়ন ঘনফুট বা এমএমসিএফ = ১ হাজার এমএমবিটিইউ)। একই সঙ্গে গ্যাসের দৈনিক স্থানীয় সরবরাহ ও মজুদ নেমে আসবে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটেরও নিচে। বাকি সাড়ে আট হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদা পূরণ করতে হবে আমদানির মাধ্যমে। গত অর্থবছরের দাম অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিলেও ২০৪১ সালে শুধু দৈনিক চাহিদা পূরণেই গ্যাস আমদানি করতে হবে ২১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের। সারা বছর গ্যাস আমদানি করতে গিয়ে এ ব্যয় দাঁড়াবে সাড়ে ৭৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। গত অর্থবছরের প্রতি এমএমবিটিইউ ২৫ ডলার দামে হিসাব করেও দুই দশক পরে গ্যাস আমদানি বাবদ মোট ব্যয় দাঁড়াবে এখনকার চেয়ে ১৭ গুণেরও বেশি।

স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এখনো গ্যাস আমদানি করেই চাহিদা পূরণের পথে এগোচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। এ আমদানিনির্ভরতা কাটাতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেই মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার, বিশেষ করে জ্বালানির বাজার খুব বেশি সংবেদনশীল। সরবরাহকারী দেশের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো ঘটনা বাজারে অনেক বড় উত্থান-পতনের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেখা যাচ্ছে, মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চলমান পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বড় ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়গুলো জ্বালানি বিভাগের হিসাবে ছিল না। সে হিসেবে আমদানিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজানোর বিষয়টিকে দূরদর্শী বলা চলে না কোনোভাবেই। আবার আমদানিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা তৈরি করা হলেও এ অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে, সে বিষয়টিও পরিকল্পনায় পরিষ্কার করা হয়নি।

গ্যাসের বর্তমান সরবরাহ সংকটের পেছনে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেই প্রধানত দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। যদিও যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল খাতটি। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রক্ষেপণ-প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এসব প্রতিবেদনে গ্যাসের আসন্ন সংকটের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মোটাদাগে প্রায় একই উপসংহার টানা হয়েছে। এগুলোয় বলা হয়েছে, তুলনামূলক সাশ্রয়ী বিবেচনায় দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের সম্প্রসারণ পরিকল্পনাগুলো নেয়া হয়েছে গ্যাসকে কেন্দ্র করে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এ চাহিদাও দিন দিন বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়তি এ গ্যাস সংস্থানের জন্য আমদানির বাইরে আর কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নেয়া হয়নি। এমনকি দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের নতুন মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজও এগোয়নি। ফলে চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান দিন দিন বাড়তে থাকায় আমদানিনির্ভরতাও বাড়বে। অতিরিক্ত এ আমদানিনির্ভরতা গোটা অর্থনীতিকেই দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের আর্থিক চাপে ফেলে দেবে।

যুদ্ধ শুরুর আগে গত বছরেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ৫৫০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে গ্যাসের মোট চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভরতা বেড়ে ৮৫ শতাংশও ছাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।

গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭ ও পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান সমন্বয়ের ভিত্তিতে ওই সময় বিইআরসি জানিয়েছিল, বর্তমানে যে হারে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি পণ্যটির অভ্যন্তরীণ মজুদ ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশে দৈনিক চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় সরবরাহের ঘাটতি ছিল ১৮৮ কোটি ঘনফুট। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৩৯০ কোটি ঘনফুট হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে। যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে গ্যাস আমদানিতে ব্যয়ের মাত্রাও বেড়ে যায়। গত অর্থবছরেই (২০২১-২২) এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে আগের চার বছরের যেকোনোটির চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ গুণ বেশি। রিজার্ভে সংকট দেখা দেয়ায় স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ। সরবরাহ কমে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনীতি। বিভিন্ন খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে অতিরিক্ত ব্যয়েই এলএনজি সংগ্রহের প্রস্তাব থাকলেও রিজার্ভ সংকটের কারণে সে পথেও হাঁটতে পারছে না সরকার।

চলতি বছরের জুনে এলএনজি আমদানি করতে অর্থ সংকটে পড়ায় পেট্রোবাংলাকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেয় সরকার। গ্যাস খাতের উন্নয়নের অর্থ আমদানিতে ব্যবহার হওয়ায় সে সময় নানা সমালোচনাও ওঠে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাড়তি এ অর্থ সংকুলান করা অর্থ বিভাগের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না। এ অবস্থায় গ্যাস আমদানিতে জিডিএফের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায়ও ছিল না।

জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানীকৃত গ্যাস দিয়ে দেশের জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখা সম্ভব নয়। বরং যে অর্থ দিয়ে এলএনজি কেনা হচ্ছে তা দিয়ে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো উচিত ছিল। কিন্তু দুই দশক ধরে এ খাতে বৃহদাকারে তেমন কোনো কিছুই হয়নি। অথচ এখন প্রতি ইউনিট গ্যাস আমদানিতে ব্যয় করতে হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের প্রায় পাঁচ গুণ। দেশে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পড়ছে গড়ে ১১ টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদে কাতার ও ওমান থেকে আমদানীকৃত গ্যাসের দাম পড়ছে ৫৩ টাকা। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি আমদানি করা হতো, সেটির দামও ছিল আকাশচুম্বী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমদানিকে প্রধান উৎস ধরে আমরা গ্যাস খাতে মহাপরিকল্পনা সাজিয়েছি। সেটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমাদের উচিত ছিল একক নির্ভরতা হিসেবে সস্তায় গ্যাস কেনার ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসা। সেটি আমরা করতে পারিনি। এখন অনুসন্ধান নিয়ে যতটা তত্পরতা দেখা যাচ্ছে, সেটি আরো আগেই হওয়া দরকার ছিল।

পেট্রোবাংলার চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গ্যাস মজুদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে আর নয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুদ রয়েছে। প্রতি বছর দেশে গ্যাসের গড় ব্যবহার হয় এক টিসিএফ। প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের আমদানি মূল্য গড়ে ১০ ডলার হিসাব করলেও এক টিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ১০ বিলিয়ন ডলার। দেশে এরই মধ্যে ১৯ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে, যার দাম দাঁড়ায় ১৯০ বিলিয়ন ডলারের মতো। বিপুল পরিমাণ অর্থের এ গ্যাস ব্যবহার করা হলেও তার ১০ শতাংশ অর্থও এ খাতের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়নি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে আমরা আমাদের গ্যাসের আর্থিক মূল্যের বিষয়টি কখনই উপলব্ধি করিনি। বৃহৎ পরিসরে গ্যাস ব্যবহার হবে এটাও আমরা চিন্তা করিনি। অথচ সাশ্রয়ী মূল্যের এ গ্যাসের ওপর আমাদের অর্থনীতি, শিল্প-কারখানা, জ্বালানি ব্যবস্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে। সংকট বিবেচনায় শিল্পায়নে জ্বালানি ব্যবহারে গ্যাসের একক নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের কথা জানান এ বিশেষজ্ঞ।

বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার বিশ্লেষণকারী বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সমাধান হলেও আগামীতে জ্বালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে এ কথা আগে থেকেই ধরে নেয়া ঠিক হবে না। বরং বিশ্ববাজার থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাওয়া যাবে এমন চিন্তা বড় ভুলের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা। গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে ব্যবস্থাপনা কীভাবে ঠিক রাখা হবে সে বিষয়ে সরকারের বড় কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। তবে চলতি বছর গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেখা যাচ্ছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের। তার দৃশ্যমান কার্যক্রমও দেখা যাচ্ছে বেশকিছু গ্যাসফিল্ডে পেট্রোবাংলার তত্পরতায়।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে জানান, উচ্চমূল্যের কারণে গ্যাস কেনার বিপরীতে আমরা স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সময়ে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরই মধ্যে ভোলা, শ্রীকাইল ও শরীয়তপুরে গ্যাসকূপ খননে কাজ চলছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা একটা রেজাল্ট পাব।

দেশে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ২৬০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। এর মধ্যে আমদানি করে ৩৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। বাকিটা স্থানীয় উৎস থেকে। অথচ পেট্রোবাংলার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি বছরে ৩৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়ার কথা ছিল। একই সময়ে গ্যাসের চাহিদার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট।

সংস্থাটি ২০৩০ সাল নাগাদ আমদানি ও স্থানীয় গ্যাসের চাহিদার প্রক্ষেপণ করেছে ৪৬০ কোটি ঘনফুট। যদিও এখনই দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪২০ কোটি ঘনফুটের মতো। প্রক্ষেপণ ও বাস্তবতার এমন চিত্রে সংস্থাটির গ্যাস সরবরাহ পরিকল্পনা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা।-বণিক বার্তা