ওয়েবিনারে বক্তারা

এভাবে কমতে থাকলে ঝুঁকিতে পড়বে রিজার্ভ

এভাবে কমতে থাকলে ঝুঁকিতে পড়বে রিজার্ভ

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যায়নি। তবে রিজার্ভ কমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে যে কোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যেতে পারে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। এর মধ্যে শুধু আগামী বছর বাংলাদেশকে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অর্থনীতিতে যা বড় চাপ তৈরি করবে। পরিস্থিতির উন্নয়নে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার কমানো এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

গতকাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এমন মত দেন বক্তারা। 'বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক ঋণ' শীর্ষক ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদসহ বিশিষ্টজন অংশ নেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যায়নি। তবে প্রতি মাসে যেভাবে কমছে তা অব্যাহত থাকলে ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় যেতে বেশিদিন লাগবে না। যে কারণে এখনই থামাতে হবে। অবশ্য আইএমএফ থেকে কম শর্তে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে সরকার। তাও ঋণ পেতে এখনও সময় লাগবে। খুব কম পূর্ব শর্ত দিলেও আইএমএফ বিনিময় হার ও সুদহার বাজারভিত্তিক করতে বলেছে। তিনি বলেন, অর্থনীতি নিয়ে নয়-ছয় করা ঠিক নয়। সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে দর বাড়িয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হবে। এছাড়া এখন রেমিট্যান্স কমার কোনো কারণ নেই। কমছে মূলত অর্থ পাচারের কারণে, হুন্ডি বেড়েছে।

তিনি বলেন, 'বিদ্যুৎ খাতে ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। ধরে নিলাম, সবাইকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাও এতদিন কেন চলবে। নিজেদের লোকদের সুবিধা দিতে বছরের পর বছর এভাবে চলতে পারে না। এখানকার মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ সবাই দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন। অথচ বন্ধের উদ্যোগ নেন না। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনুমোদন লাগে। ইউএনওরা আগে যেখানে মোটরসাইকেল চালাতেন এখন পাজেরো গাড়িতে চড়েন।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আমদানি বাড়লে স্বল্পমেয়াদি দায় বাড়ে। গত বছর আমদানিতে বিশাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর বিপরীতে সে হারে রপ্তানি হয়নি। যে কারণে ডলার সংকটে পড়ে অনেক ব্যাংক এখন এলসির দায় নিষ্পত্তি করতে পারছে না। নতুন এলসিও খুলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঢালাওভাবে বিদেশি ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন দিয়ে রেখেছে। আইএমএফ তা ধরেই হয়তো হিসাব করেছে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। আবার এলসি কমতে শুরু করেছে। এসব ধরেই আইএমএফ খুব কম শর্ত দিয়ে বাংলাদেশের ঋণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যা-তা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ না পেলেও সরকারকে ভাড়া দিতে হচ্ছে। এখান থেকে যারা বাড়তি টাকা পেয়েছেন, বেশিরভাগই বাইরে নিয়ে গেছেন। বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বেশি মূল্য দেখিয়ে এলসি খোলা হয়েছে। যে কারণে তার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে না। ডলার সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ এসব। অথচ আইএমএফ খুব কম শর্তে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। এর কারণ হতে পারে সংস্থাটিও বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান চায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। তবে দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে, অর্থ পাচার বন্ধ না হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমবে। অনেকেই কর্মসংস্থান হারাবে। হঠাৎ-হঠাৎ দেখা যাবে বাজার থেকে চিনি উধাও, এই পণ্য উধাও, ওই পণ্য উধাও। এভাবে সমাজে অসমতা বাড়বে। তিনি বলেন, মূল্যস্ম্ফীতি বলা হচ্ছে ৯ শতাংশ। তবে অনেকে মনে করেন হিসাবে গন্ডগোল আছে। যে কোনোভাবেই মূল্যস্ম্ফীতি ২০ শতাংশের বেশি উঠলে আর জন অসন্তোষ ঠেকানো যাবে না। এছাড়া ডলারের দর বাজারভিত্তিক করতে না পারলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়বে না। আমদানিও কমানো যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, অর্থনীতির সংকট নিয়ে কথা হলেও দুর্নীতি বা অপচয় নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সোচ্চার নন। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে না পারলে অর্থনীতির সংকট দূর হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সিনিয়র সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে যুক্ত হন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ আরও কয়েকজন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক জিয়া হাসান। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথচ বিভিন্ন জায়গা থেকে বলা হচ্ছে পরিশোধ করতে হবে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। বিপুল অঙ্কের এই দায় সৃষ্টির প্রধান কারণ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ। গত বছর যে আমদানি হয়েছে তার ৩০ শতাংশই ঋণের বিপরীতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারের ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানির জন্য এ ঋণ নেওয়া হয়। ফলে এ ধরনের ঋণের মেয়াদ খুব একটা বাড়বে না। যে কারণে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।