সম্পদ নয়, বোঝায় রূপ নিতে পারে পায়রাকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো

সম্পদ নয়, বোঝায় রূপ নিতে পারে পায়রাকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো

পটুয়াখালীর পায়রাকে দক্ষিণাঞ্চল তথা দেশের বৃহৎ এক লজিস্টিক হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। এজন্য সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর মধ্যে পায়রাকে গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপ দেয়ার পরিকল্পনাটি থেকে ২০২১ সালে সরে আসে সরকার।

মূলত অর্থনৈতিক ফলাফল ও বাড়তি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বিবেচনায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্পটি থেকে সরে এসেছিল সরকার। পায়রা বন্দরটি যেখানে অবস্থিত, সেখান দিয়ে প্রতি বছর উজান থেকে আসা বিপুল পরিমাণ পলি প্রবাহিত হয়। এজন্য নিয়মিত ড্রেজিং ছাড়া বন্দরটি চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরাও। সরকারের প্রত্যাশা, চালু হওয়ার পর পায়রা বন্দরের আয় দিয়েই ব্যয়বহুল ড্রেজিং কার্যক্রমসহ অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পায়রা বন্দরের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

তাদের ভাষ্যমতে, বন্দরের নাব্যতা ধরে রাখতেই প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। রাবনাবাদ চ্যানেলে নাব্যতা সংকটের কারণে এখান দিয়ে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হয়েছে। বন্দরটিতে এখন জাহাজও আসছে খুবই কম। চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোপুরি শেষ হলে বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপআঞ্চলিক বাণিজ্য হাবে রূপ নেবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার। যদিও বন্দরের আশপাশ এলাকার নাব্যতা সংকটের কারণে এ প্রত্যাশা পূরণ নিয়েও রয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা। এখন পর্যন্ত বন্দরটিতে জাহাজ ভেড়ার সংখ্যাও অনেক কম। ২০১৬ সালে চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বন্দরটিতে জাহাজ নোঙর করেছে মাত্র কয়েকশ। সামনের দিনগুলোতেও এ সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে। পায়রা বন্দরকে গড়তে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল থেকেও অর্থ নিতে হয়েছে সরকারকে। প্রতি বছর পায়রা বন্দরের আশপাশ এলাকায় কয়েক কোটি ঘনমিটার পলি জমা হচ্ছে। বন্দরটিকে কর্মক্ষম রাখতে এর অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়ছে। এ কাজের ব্যয় নির্বাহ করতে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল থেকে অনুদান হিসেবে দেয়া হয়েছে প্রায় ৪৬২ কোটি টাকা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পায়রা বন্দর নিয়ে যে সমীক্ষা হয়েছিল, সে প্রতিবেদনেই বলা আছে, বন্দরটি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। বন্দরটি এখন অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেও। পায়রা বন্দরকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চল এরই মধ্যে জাগরিত হয়েছে। শুধু বন্দরে কতটুকু পণ্য ওঠানামা করল, সেটি বড় কথা নয়। এটিকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির যে সম্ভাবনা তৈরি হলো, সেটিই বড় কথা। আর বন্দর তো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে মাত্র। কেবল এর প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে। এখনই এর সুফল পাওয়া যাবে না।’

চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল পায়রার কাজে লাগানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন পায়রা বন্দর হয়, তখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে টাকা নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের টাকা মানে সরকারেরই টাকা। সরকার মনে করেছে, এখান থেকে টাকা নিয়ে ওখানে দেবে, সেটিই হয়েছে।’

পায়রা এলাকাকে ঘিরে নেয়া অন্য প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়েও রয়েছে বড় ধরনের আশঙ্কা। এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানির পণ্য পরিবহনকে সুবিধাজনক করতে একটি রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত গভীর সমুদ্রবন্দর না হওয়ায় এখান দিয়ে যে পরিমাণ কনটেইনার পরিবহনের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, তা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ শুরু করা যায়নি বিনিয়োগের অভাবে।

উচ্চমূল্য ও রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার বিদ্যমান দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) বা ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সরবরাহ সক্ষমতা নেমেছে ৫০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যেই আবার পায়রায় আরেকটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে পেট্রোবাংলার এখন আলোচনাও চলছে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটির মাধ্যমে পায়রা থেকে খুলনা পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনও নির্মাণ করতে চায় এক্সিলারেট এনার্জি।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো, আমদানিনির্ভর এলএনজির ওপর নির্ভর করে এ ধরনের ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ হলে তা একসময় বড় ধরনের অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, পায়রায় টার্মিনালটি নির্মাণ হওয়ার পর এর পুনরাবৃত্তি হলে তা বড় ধরনের চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারকে চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে টার্মিনাল ভাড়া, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ ও সক্ষমতার অব্যবহূত চার্জ পরিশোধ করতে হবে। আবার এ ব্যয়ের বোঝাও টানতে হবে দীর্ঘদিন ধরে।

পায়রায় এখন নির্মাণ হচ্ছে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যদিও জ্বালানির অভাবে এখানকার চালু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ঋণ পরিশোধ নিয়ে এরই মধ্যে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটে ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি অব্যাহত রাখতে পারছে না কোম্পানি দুটির জয়েন্ট ভেঞ্চার বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কয়লা মজুদ নিঃশেষের পথে। নতুন জ্বালানি আমদানি করা না গেলে ফেব্রুয়ারির আগেই বন্ধ হয়ে পড়তে পারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লা আমদানিতে এলসি খুলতে পারছে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে কয়লার মজুদ রয়েছে মাত্র ১৫ দিনের, তাও একটা ইউনিট বন্ধ থাকার কারণে। দুটো ইউনিট চালু হলে তা চলবেই না। এ হলো কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামও অনেক বেড়েছে, প্রায় ১০ গুণ। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা এলএনজি টার্মিনাল কোনোটিই চালু রাখা যাবে না।’

এ অর্থনীতিবিদের ভাষ্যমতে, পায়রা বন্দরের ব্যাপারটা হলো, সেটি কখনই গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না। এর রাবনাবাদ চ্যানেলে বেশকিছু জায়গায় গভীরতা আছে মাত্র সাত মিটার। ফলে সেখানে বড় জাহাজ আসতে পারবে না। কিন্তু ছোট কয়লার জাহাজ আসতে পারবে। বড় কয়লার জাহাজ দূরে নোঙর করে লাইটারেজের মাধ্যমে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে খরচটা অনেক বেশি পড়বে। পায়রা কখনই গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না। এজন্য গভীর সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক যেসব কার্যক্রম, সেগুলোর কোনোটাই চালু হবে না বা চালু রাখা যাবে না। সেদিক থেকে চিন্তা করলে পায়রা বন্দরকে কখনই ভালো বিনিয়োগ প্রকল্প বলা চলে না। এসব মহাপরিকল্পনা বিপদের মুখে পড়বে। এটিই হলো আসল কথা।

কয়লা আমদানি নিয়ে সংকটের মধ্যেই পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। চীনা ঋণে নির্মীয়মান এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটিতেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হবে আমদানীকৃত কয়লা।

এর মধ্যে একটি নির্মাণ করছে এনডব্লিউপিজিসিএল ও সিএমসি। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ এগিয়েছে ৪০ শতাংশের বেশি।

সমান সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে আরপিসিএল ও চীনা প্রতিষ্ঠান নরিনকো। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এটির কাজ এগিয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি।

সার্বিক বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উন্নয়নের মূল লক্ষ্যমাত্রা হতে হবে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগের মূল কেন্দ্রটিও হবে বঙ্গোপসাগর। সুতরাং এখানে বন্দরকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলোও হতে হবে ওই বিষয়কেন্দ্রিক। এছাড়া আমাদের দেখতে হবে এখানে যাতায়াতের সুবিধা কেমন আছে, পানির স্তর কেমন আছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে রাজনীতির অ্যাডহক স্বার্থ দিয়ে খুব বেশি ফায়দা পাওয়াও সম্ভব নয়। এক পর্যায়ে এ ধরনের বিনিয়োগ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।’

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমার তিনটি বক্তব্য। প্রথমটি হলো বঙ্গোপসাগরকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনুপস্থিতিতে অ্যাডহক পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। এখানে বন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন জায়গায় প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল হবে, কোন জায়গায় কার্গো টার্মিনাল হবে এবং কোন জায়গায় নেভাল টার্মিনাল হবে, এটি তো বাংলাদেশের প্রয়োজন ও কারণ অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেকোনো টার্মিনাল করতে গেলে আগে চিন্তা করতে হয় এর টেকনো-ইকোনমিক ফিজিবিলিটি। এক্ষেত্রে গভীরতা, নৌ-চলাচল সুবিধা ও পলিপ্রবাহের বিষয়টি এর মধ্যে থাকতে হবে। সেটি কিন্তু বন্দর বা এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, নীতিগত জায়গায়ও সামঞ্জস্যের প্রয়োজন। একদিকে আমরা আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের উপস্থাপন করছি জলবায়ু পরিবর্তনের ভিক্টিম হিসেবে। আবার জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কার্যক্রমও চালাচ্ছি। এটি তো হতে পারে না। এ তিন বিষয়ই বলে দিচ্ছে, এখানে দূরদর্শিতার কোনো ছাপ নেই। এসব স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’-বণিক বার্তা