খরচের বোঝা বাংলাদেশের, চুক্তিতে লাভ আদানিরই

খরচের বোঝা বাংলাদেশের, চুক্তিতে লাভ আদানিরই

ভারতের আদানি গ্রুপের কেন্দ্র থেকে ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। শিগগিরই এই বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হতে যাচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কিনতে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ভারতের সংসদেও এই প্রকল্প নিয়ে কথা হচ্ছে, আদালতে মামলা হয়েছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে আদানির বৈশ্বিক বাণিজ্যে ধস নামলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিক্রি ভারতীয় কোম্পানিটির জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্নিষ্টদের।

সূত্র জানিয়েছে, প্রথমে কয়লার অতিরিক্ত দর নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল, যা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এখন আলোচনা চলছে। তবে পিপিএ বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, শুধু কয়লার দাম নয়, কর ছাড়, ক্যাপাসিটি চার্জ, কয়লার ক্যালরিক ভ্যালু, কয়লা কেনা, কয়লা পরিবহন, বিদ্যুৎ কেনার শর্তসহ অনেক বিষয়েই আদানি বাড়তি সুবিধা ভোগ করবে। খাত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই বাড়তি সুবিধা না থাকলে বিদ্যুতের দাম কম হতো। তারা বলছেন, চুক্তির দুর্বলতার কারণে বাংলদেশকে অতিরিক্ত খরচের বোঝা ২৫ বছর টানতে হবে। জনস্বার্থে চুক্তি সংশোধন অথবা বাতিলের দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি: আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিপিএ ও সমমানের অন্য দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পিপিএ বিশ্নেষণ করে খাত সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, আদানির চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করা হয়েছে ট্যারিফ ফর্মুলায়। এর ফলে পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পিপিএ অনুসারে ক্যাপসিটি চার্জের পরিবর্তনশীল অংশটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে। প্রথম বছর প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে ২১.৮৯২৭ মার্কিন ডলার। ২৫তম বছরে তা কমে হবে ১৪.৬২৭০ মার্কিন ডলার। ক্যাপসিটি চার্জের অপরিবর্তনশীল অংশটি আদানির পিপিএতে প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ৩.৬৫ ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে কস্টপ্লাস ফর্মুলায়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক আসবে।

পাওয়ার সেলের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি পড়ছে। পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের ১২৪৪ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৩ পয়সা। চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে এস আলম গ্রুপের ১২২৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রর প্রতি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ টাকা ৭১ পয়সা। বরগুনার বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার ৩০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ধরা হয়েছে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা। আদানির ঝাড় খণ্ডের ১৬০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকা ৫৫ পয়সা।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আদানি ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ না কিনলেও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। ২৫ বছরে এ চার্জ পরিশোধে বাংলাদেশের ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।

কয়লায় কারসাজি: চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি খরচ পিডিবি বহন করে, যা বিদ্যুতের দামের সঙ্গে যুক্ত থাকে। পিপিএতে এই জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি উল্লেখ করা থাকে। পিপিএ বিশ্নেণকারী একাধিক ব্যক্তি সমকালকে জানিয়েছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে কয়লার দর নির্ধারণে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আদানির চুক্তিতে এমন সুযোগ নেই। আদানির পিপিএ'র শিডিউল ৬-এর টেবিল সি'তে কয়লার দর নির্ধারণের ফর্মুলা দেওয়া আছে। এটি অনুসারে দর নির্ধারণে ইন্দোনেশিয়ান কোল ইন্ডেপ এবং নিউ ক্যাসেল ইনডেপ এর গড় হিসেব করা হবে। এছাড়া চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করলেও চার হাজার ৬০০ ও ছয় হাজার ৩২২ কিলোক্যালরির কয়লার মিশ্র দাম নিতে পারবে আদানি।

সমালোচনা ওঠার পর সম্প্রতি ঢাকায় কয়লার দর নিয়ে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা পায়রার মতো ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টরে দর নির্ধারণে রাজি হয়।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ছাড় দিলেও আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হবে। কারণ পায়রা বা রামপালের কয়লা বিদেশ থেকে সমুদ্রপথে এসে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্নিষ্ট জেটিতে খালাস হয়। কিন্তু আদানির ঝাড়খণ্ডে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা তাদের মালিকানধীন অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনি থেকে সমুদ্র পথে এসে আদানির নিয়ন্ত্রণধীন ওডিশার ধামারা সমুদ্র বন্দরে খালাস হওয়ার কথা রয়েছে। সেখান থেকে রেল পথে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেওয়া হবে। এতদূর পথ কয়লা পরিবহনের খরচের পাশাপাশি একাধিক রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ট্যাক্স-ভ্যাট ইস্যু রয়েছে। সব মিলিয়ে কয়লার চূড়ান্ত দর বেড়ে যাবে। আদানি ওয়াচের বিশ্নেষণ অনুসারে আদানির কয়লার দর প্রচলিত মূল্যের তিনগুণ হবে।

এছাড়া কয়লা নিয়ে আরও ব্যবসার সুযোগ রয়েছে আদানির। চুক্তির ১৩.১-এর (জি) ধারার (৪) উপধারায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি যদি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনে তাহলে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। আবার ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনলে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পায়রাসহ দেশের অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রর চুক্তিতে এমন শর্ত নেই।

কর ছাড়ের সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ: সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদন অনুসারে আইনে পরিবর্তন এনে ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে ২০১৯ সালে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণা করে ভারত সরকার। এর ফলে নানা ধরনের কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। ২৫ বছরে কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে প্রদেয় এক ধরনের কর মওকুফ বাবদ আদানির ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। এ ছাড়া কয়লা ও যন্ত্রাংশ আনতে কোনো আমদানি শুল্ক দিতে হবে না। প্রথম পাঁচ বছরের জন্য আয় করে ১০০ শতাংশ ছাড়, পরের পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশ। সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, পিপিএ সই হওয়ার ১৫ মাস পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোড্ডা প্রকল্প এসইজেড বলে ঘোষিত হয়। এমন সুবিধা প্রাপ্তির পরপরই পিডিবিকে জানানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি। যদিও চুক্তির ১৩ ডি (আই) ধারা অনুযায়ী, কর শুল্ক পরিবর্তন হলে তা পিডিবিকে অবশ্যই ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত জানাতে হবে।

পিপিএ বিশ্নেষণবারী একাধিক ব্যক্তি সমকালকে বলেন, পিডিবি কর ছাড় সংক্রান্ত এসব সুবিধা পেলে বিদ্যুতের মূল্য অনেক কমে আসবে। কিন্তু চুক্তি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে বাংলাদেশ কর ছাড়ের সুযোগ ভোগ করতে না পারে। ফলে আদানি কর সুবিধায় লাভ করলেও বাংলাদেশকে ঠিকই এসব খরচ বহন করতে হবে। কারণ বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ভারতের এ সংক্রান্ত সব ধরনের শুল্ক ও কর হিসাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১২ শতাংশ আবগারি শুল্ক, ১৫ শতাংশ পরিষেবা কর, ভ্যাট, ভারতে প্রদেয় আয়কর ইত্যাদি।

চুক্তির বিরোধীতা: গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অসম, অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা সংশোধন এবং প্রয়োজনে চুক্তি বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছে। এতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চুক্তিটিতে আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থকে এমনভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এই প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে যেতে পারে, যার বোঝা এ দেশের জনগণকে বইতে হবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে এমনিতেই হরিলুট চলছে। বিশেষ আইনের সুযোগে দরপত্র ছাড়াই শতাধিক বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তির জালিয়াতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গলার কাটা হবে উল্লেখ করে তিনি তা বাতিলের দাবি জানান।

চুক্তি নিয়ে কথা বলতে আদানির ঢাকা অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎ অন্য কেন্দ্রগুলোর মতোই হবে। এতে বাংলাদেশের লোকসান হবে না। বরং উত্তরাঞ্চলের লোডশেডিং থেকে পরিত্রাণ মিলবে।-সমকাল