ছাত্রলীগ নেতার এলোপাতাড়ি চড়ে কান ফাটলো জাবি শিক্ষার্থীর

ছাত্রলীগ নেতার এলোপাতাড়ি চড়ে কান ফাটলো জাবি শিক্ষার্থীর

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের গেস্টরুম চলাকালীন এলোপাতাড়ি চড় মেরে এক শিক্ষার্থীর কান ফাটানোর অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ ফরিদ ও ইতিহাস বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরানের বিরুদ্ধে। তারা উভয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম সজীব আহমেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।

সজীব আহমেদ বলেন, ঝামেলাটা শুরু হয়েছিল বহিরাগত একজনের সঙ্গে। তিনি আমাদের বড় ভাইদের গেস্ট ছিল। এ ঝামেলার কারণে আমাদের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে ডেকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নাঈম (রসায়ন-৪৮), সিয়াম (প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ-৪৮) ও আমাকে কানে ইচ্ছামতো মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি কানে হাত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করলে হাত সরিয়ে মারধর করেছে ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের ফরিদ ভাই। আমি অসুস্থ হলে শুয়ে পড়ি, কিন্তু তারা আমাকে বসতেও দেয়নি।

ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে যেতে দেয়নি। আমি নাটক করছি বলে লাথি দেয়ার চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মোস্তাফিজুর রহমান। ভুক্তোভোগী আরও জানায়, আমাকে জাবি মেডিকেলে নেয়ার পর ডাক্তাররা এনাম মেডিকেলে সুপারিশ করলে ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে হলের বড় ভাইরা আমাকে যেতে দেয়নি। পরে বন্ধুরা জোর করে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান, আমার কানের পর্দা অনেকটা ফেটে গেছে। এক মাস পরে জানা যাবে শুনতে পাবো কিনা। অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে ভুক্তভোগী বলেন, ‘তারা ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাদের কারোরই ছাত্রত্ব নেই। কার কাছে অভিযোগ দিবো।’

ঘটনার পর সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল রাজিসহ কয়েকজন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কয়েকজন এসেছিল। শিক্ষার্থীর কান দিয়ে রক্ত পড়ছিলো। তাকে এম্বুলেন্সে করে এনাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এনাম মেডিকেল হাসপাতালের একটি প্রেসক্রিপশন প্রতিনিধির কাছে এসেছে। এতে রোগীকে তিন মাস কানে পানি না ঢুকানো, কানে তেলে ভেজা তুলা দিয়ে গোসল করা, পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এর আগে ২১শে মার্চ দুপুর সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দিবেন্দু দিব্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। পরে তাকে হলের গেস্টরুমে তুলে এনে বেধড়ক মারধর করেন। এই ভুক্তভোগী জাবি ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজি সরকারের পরিচিত হওয়ায় হলের সিনিয়রদের নিয়ে মিটিং হয়। মীমাংসা শেষে ভুক্তভোগী ক্ষমা চেয়ে চলে যাওয়ার সময় হলের জুনিয়র কর্মীরা আবারো চড়াও হয়। এই ঘটনাসহ হলের অন্য ঘটনা নিয়ে রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হয় গেস্টরুম। চলে রাত ১টা পর্যন্ত। গেস্টরুমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রসায়ন বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, মার্কেটিং বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ পরান, একই বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজি সরকার।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, আনুমানিক রাত ১০টা ৪০ মিনিটে সজীবের কানে এলোপাতাড়ি চড় মারে ফরিদ। এতে সজীবের কান ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। সে কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করে, ‘ভাই, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর রাজনীতি করবো না। বাসায় চলে যাবো।’ এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান বলেন, ও নাটক করতেছে। ওরে তোল। আজকে এই গেস্টরুম থেকে ওর লাশ বের হবে।’ পরে সজীবকে নিয়ে মেডিকেলে যাওয়ার সময় হল গেটে বাধা দেয় ইমরান। ‘আগে দেখ সে নাটক করতেছে কিনা। ২০-৩০ মিনিট অবজার্ভ কর। তারপরে মেডিকেলে নিয়ে যা। আর এখন মেডিকেলে নিয়ে গেলে নিউজ হবে। তখন আমরা বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারবো না।’ ইমরান এভাবেই জুনিয়রদের শাসাচ্ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন হল গেটে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা। এরপরে ইমরান সজীবকে হলগেটে আরও ১৫-২০ মিনিট আটকে রাখে। পরে সজীবের অবস্থা খারাপ হলে তাকে প্রথমে বিশ্ববিদালয়ের কেন্দ্রীয় মেডিকেলে এবং পরে সাভারের এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযুক্ত হাসান মাহমুদ ফরিদ বলেন, ‘তার কানে সমস্যা ছিল। আমাদের মিটিং চলছিলো। মিটিংয়ের মাঝে তার কান দিয়ে রক্ত পড়ছিলো। তখন আমাদের ভাইয়েরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।’ অভিযুক্ত ইমরান গেস্টরুমের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘ভুক্তভোগীর সারাদিন ক্লাস-অ্যাসাইনমেন্ট থাকার ফলে গেস্টরুমে এসে শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ গেস্টরুমের ব্যাপারে তিনি বলেন, রোজার আগে এটি আমাদের রুটিন গেস্টরুম। নির্দিষ্ট করা ছিল না, আজকে আমাদের হয়েছে কাল হয়তো বা অন্যদের হবে। রোজায় সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য এ গেস্টরুম। অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ বলেন, রোজার আগে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিতে গেস্টরুম ডাকি। এ ছাড়াও গেস্টরুমে কর্মীদের সমসাময়িক কিছু মারধরের ঘটনা বিষয়ে জানতে আমরা তাদের নিয়ে বসি।’ অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন গেস্টরুমের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গেস্টকে জুনিয়ররা মারধর করলে আমরা বিষয়টি সমাধান করি।’ কান ফাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কার কানের ভেতর কী ছিল এটাতো আমরা জানি না। সে অসুস্থ ছিল ডাক্তার বললো। মারধরের কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি।’ অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযুক্ত আল রাজি সরকার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ওবায়দুর রহমান বলেন, আসরের নামাজের সময় উপস্থিত হলে বহিরাগতকে ধরে আনার বিষয়টি জানতে পারি। পরে ভুক্তভোগী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলি। তারা উভয়ে মীমাংসা হয়েছে জানালে আমি চলে আসি। এবং আমাদের ওয়ার্ডেনকে ঘটনাটি খোঁজখবর রাখতে বলি। তিনি আরও জানান, রাতে হলের গেস্টরুমে সজীব নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে জেনেছি। ভুক্তভোগী ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি। সে অভিযোগ দিলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।