ট্রিপল সেঞ্চুরির পথে ব্রয়লার

ট্রিপল সেঞ্চুরির পথে ব্রয়লার

মাত্র দু’মাস। বাজারে ১৬০ টাকা কেজি ছিল ব্রয়লার মুরগি। এরপর থেকেই দফায় দফায় বাড়ছে দাম। রোজা শুরুর আগ মুহূর্তে এসে ফের বেড়েছে দাম। এখন ট্রিপল সেঞ্চুরির পথে ব্রয়লার মুরগি। গত দুই মাসে ১০০ টাকার বেশি বেড়েছে ব্রয়লারের দাম।

এর প্রভাব পড়েছে অন্য জাতের মুরগির দামেও। সোনালী, দেশি মুরগির দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এখন তা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। মুরগির দাম বাড়ার কারণে প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে। তাই মুরগির বাজারে এখন ক্রেতাও কম। ব্রয়লার মুরগির দাম এতো বেশি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতাও খুঁজে পাচ্ছে না ভোক্তা অধিদপ্তর। চলতি বছরের শুরু থেকেই হঠাৎ করে বাড়তে থাকে মুরগির দাম। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বংলাদেশ-এর (টিসিবি) বাজার দরে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে ১৪৫ থেকে ১৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছিল ব্রয়লার মুরগি। কয়েক দফায় বেড়ে এর পরের মাসের একই সময়ে ডবল সেঞ্চুরিতে ঠেকে ব্রয়লার মুরগি। আর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে ব্রয়লার মুরগি। দাম গিয়ে ঠেকে ২৫০ টাকায়। বর্তমান রোজার আগে আরেক দফা ব্রয়লারের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা। এখনই লাগাম টানা না গেলে ব্রয়লার মুরগি শিগগিরই ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মুরগির দাম ২৭০ টাকা হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতে কাওরানবাজারের এক মুরগি ব্যবসায়ী বলেন, ‘কেন দাম বাড়ছে আমরা কিছু জানি না। যেই দামে কিনি সেই দামেই বিক্রি করি। ২-৩ দিনের মধ্যে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়ছে দাম।’ বাজারে মুরগির সরবরাহ কমার কারণে দাম বাড়ছে বলেও দাবি করেন অনেক ব্যবসায়ী। যদিও গতকাল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

তিনি বলেন, ব্রয়লার মুরগি নিয়ে আমাদের সমস্যা। আর কোথাও সমস্যা নেই। আগামীকাল থেকে যদি ব্রয়লার মুরগি সঠিক দামে না আসে, ওদের (খুচরা ব্যবসায়ী) বিরুদ্ধে মামলা হবে, মিল মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, যারা ব্রয়লার তৈরি করেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করে সরকারের কাছে আটটি সুপারিশ জমা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ব্রয়লারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যজাতের মুরগির দামও বেড়েছে। বর্তমানে সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা কেজিতে। দুই মাস আগেও তা বিক্রি হয়েছিল ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায়। এছাড়া দেশি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় যা দুই মাস আগেও বিক্রি হয়েছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। প্রান্তিক খামারিরা জানান, পোল্ট্রি খাতে বড় অনিয়ম হচ্ছে। কিছু চক্র সংকট ও ফিডের দাম বৃদ্ধি দেখিয়ে কারসাজি করছে। মুরগির বাচ্চার দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। তারপরও প্রান্তিক খামারিদের কাছে বাচ্চা সরবরাহ করা হচ্ছে না। মুরগির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের (বিপিসি) সভাপতি সুমন হাওলাদার।

তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কিছু করছে না। দায়িত্বটা তাদের। বর্তমানে করপোরেট কোম্পানি উৎপাদন করার ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা উৎপাদন থেকে সরে গেছে। এই কারণেই দাম বাড়ছে। বাংলাদেশের বাজার এখন করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। আমি অনেক আগে থেকেই ব্রয়লার বাজার অস্থিতিশীলের কথা বলে আসছি। বিভিন্ন অধিদপ্তরে জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছি সোনালী মুরগির সর্বোচ্চ বাজার হওয়া উচিত ৩০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির সর্বোচ্চ বাজার হওয়া উচিত ২০০ টাকা। কিন্তু আমাদের উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে দিয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এখন একটা বচ্চার মূল্য ৯৫ টাকা। করপোরেট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি না করায় তারা আমাদেরকে এখন বাচ্চাও দিচ্ছে না।

প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদনে ফিরে আসতে দিচ্ছে না। তারা ফিডের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা ১৮ দিনে প্রতিটন ফিডে ৪ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খামারিদের আবার কম দামে ফিড দিচ্ছে। বাচ্চার দামও কম রাখছে। তারা বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক তদারকি করে মূল্য নির্ধারণ করে দিক। নইলে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ হবে না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, এখন এমনিতেই অনেক জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এরমধ্যে মুরগির দাম এভাবে বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রান্তিক খামারিদের ১৫০-১৬০ টাকা খরচ হয় একটা মুরগি উৎপাদনে। তাহলে সেই মুরগির দাম সর্বোচ্চ হলে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এখন তা ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা হয়ে গেছে। এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। কিছু মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান ব্রয়লারের ব্যবসা করছে এবং তারা বিভিন্নভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সকাল-বিকাল মুরগির দাম নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আছে। তারা যদি যথাযথ ব্যবস্থা না নেয় তাহলে বাজার ঠিক হবে না। সরকারের সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। যারা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে অপরাধ করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।