দেশে দেশে রিজার্ভে কমেছে ডলারের হিস্যা, ৫৫ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমে গেল এক বছরে

দেশে দেশে রিজার্ভে কমেছে ডলারের হিস্যা, ৫৫ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমে গেল এক বছরে

আন্তর্জাতিক লেনদেনে এত দিন মার্কিন ডলারের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, তা কমতে শুরু করেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেনে অনেক দেশ এখন নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করছে। রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও ডলারের কদর কমছে।

ইয়াহু ফাইন্যান্সের এক সংবাদে বলা হয়েছে, গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের বাড়তি দরের কারণে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রার ভান্ডারে ডলারের হিস্যা ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে; আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে যা ছিল ৫৫ শতাংশ। অথচ ২০০০ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে ডলারের হিস্যা ছিল ৭১ শতাংশ। রিজার্ভে ডলারের হিস্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ইউরো ও চীনা ইউয়ানের হিস্যা বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক বাজারে এত দিন মার্কিন ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ডলারের মূল্যের সাপেক্ষে অন্য দেশগুলোর মুদ্রার মান বিচার করা হয়। ৮০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বাজারে একচ্ছত্রভাবে ছড়ি ঘুরিয়েছে ডলার। অন্য কোনো দেশের মুদ্রা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এত প্রাধান্য পায়নি। কিন্তু গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারের আধিপত্য খর্বের চেষ্টা জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
ইউয়ান, রুবল, ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন গত এক বছরে বেড়েছে।

গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ টানা সাতবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। এতে ডলারভিত্তিক বন্ড আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর বিনিয়োগকারীরা এর পেছনে ছোটেন। ফলে, বছরের প্রথম ৯ মাসে সারা বিশ্বে ডলারের বিনিময় হার ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পরে অবশ্য নীতিসুদ বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসায় ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক সুইফট ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় দেশটিকে। ফলে, ভিন্ন উপায়ে লেনদেনের বিকল্প থাকে না তাদের হাতে। সেটাই করছে তারা, ক্রেতাদের রুবলে গ্যাস কিনতে বাধ্য করে। চীন আগে থেকেই নিজেদের মুদ্রা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। ভারতও অনেক দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করছে। গত এক বছরে সেই প্রক্রিয়া অনেক বেগবান হয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি জানা গেল, ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এই প্রথম ইউয়ানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সিংহভাগ লেনদেন ডলার বা ইউরোতে হয়নি, বরং হয়েছে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে। অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি—উভয় দিক থেকেই এটি অনেক বড় ঘটনা। এতে প্রথমত ইউয়ানের ওপর রাশিয়ার আস্থা বেড়েছে; দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুটি দেশের এই সিদ্ধান্ত মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থাৎ বিশ্ববাণিজ্যে প্রধান মুদ্রা হওয়ার পথে আরেক ধাপ এগোল ইউয়ান। মার্চ মাসে মস্কো এক্সচেঞ্জে ইউয়ান লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলেও জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সিকিউরিটির ওপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে চীন। গত জানুয়ারি মাসে টানা ষষ্ঠ মাসের মতো ট্রেজারি সিকিউরিটির পরিমাণ কমিয়েছে দেশটি। অবশ্য এই তথ্য শুধু জানুয়ারি পর্যন্তই প্রকাশ করা হয়েছে, পরের দুই মাসের তথ্য এখনো অপ্রকাশিত। সেখানেও একই ধারা দেখা যাবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

এদিকে বিশ্বের মোট ১৮টি দেশে ‘স্পেশাল রুপি ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট’ বা এসআরভিএ খোলায় অনুমতি দিয়েছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)।

রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, বতসোয়ানা, জার্মানি, ব্রিটেন, ফিজি, গায়ানা, ইসরায়েল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ওমান, তানজানিয়া, উগান্ডার মতো মোট ১৮টি দেশ আরবিআইয়ের তালিকায় আছে। এই দেশগুলো নিজ নিজ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারে আগ্রহ হারিয়েছে। ডলারের বিকল্প হিসাবে তারা ভারতীয় মুদ্রায় উৎসাহ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।

ভারতও এখন তার নিজস্ব মুদ্রায় ৪৪টির বেশি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।

এদিকে ২০০৮ সালের পর আবারও বড় ধরনের সংকটে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত। দেশের ষোড়শ বৃহত্তম ব্যাংক এসভিবি ও তার তিন দিন পর সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আবারও দেশটির আর্থিক খাত নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গেও ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আরও বেশি করে ‘ডি-ডলারাইজ়েশন’-এর দিকে ঝুঁকতে চাইছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি।

শুধু চীন, রাশিয়া, ভারতই নয়, ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি পলিটিকোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউরোপকে ডলারের ওপর অতি নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মধ্যে ইউরোপের আটকে পড়া চলবে না।

ইয়াহু ফাইন্যান্সের সংবাদে জানা গেছে, সম্প্রতি চীনের টোটাল এনার্জিস ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি সিএনওওসির মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এর আওতায় চীন নিজ মুদ্রা ইউয়ানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ডলারের ওপর অতি নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছেন।

চীন আবার শুধু ফ্রান্স নয়, সৌদি আরবের কাছ থেকেও ইউয়ানে তেল কেনার চেষ্টা করছে। সেটা সফল হলে পেট্রো ইউয়ানের উত্থান সম্ভব খুব একটা দূরে নয়; বিশ্লেষকেরা এমনটাই মনে করছেন।

এশিয়া টাইমস সূত্রে জানা যায়, এশীয় দেশগুলোর কাছে মার্কিন সরকারের বিপুল ঋণ। বিষয়টি হলো, এশিয়ার দেশগুলো বিপুল পরিমাণে মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কিনেছে। দেনার এই অঙ্ক প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ জাপান, তারপরই চীন। দুটি দেশই অতিমাত্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং বাণিজ্য সহযোগিতা দিতে ডলারে সম্পদ রাখাই ছিল এত দিন তাদের একমাত্র উপায়।

এর আগে ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটকালেও মার্কিন সম্পদে বিনিয়োগ করা নিরাপদ কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছিল এশিয়ার দেশগুলো। ১৫ বছর পর আবার একই ধরনের এক শঙ্কার মধ্যে পড়েছে দেশগুলো। তবে পার্থক্য হলো, এবার তাদের হাতে বিকল্প আছে। বিকল্প সেই ব্যবস্থা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের বিকল্প হয়তো আগের মতো এককেন্দ্রিক হবে না, বহুকেন্দ্রিক হবে।