ডয়েচে ভেলের রিপোর্ট

নোবেলজয়ী ইউনূসের বিরুদ্ধে কেন দমনপীড়ন চালাচ্ছে বাংলাদেশ?

নোবেলজয়ী ইউনূসের বিরুদ্ধে কেন দমনপীড়ন চালাচ্ছে বাংলাদেশ?

ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযোগের নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। তারা একে বিচারিক হয়রানি বলে অভিহিত করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি বড় রকম হুমকি বলেও সতর্ক করেছেন। তবে এসব সতর্কতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু অনেক বছর ধরে তিনি আইনি চাপ মোকাবিলা করছেন। এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ করেছেন কমপক্ষে ১৭০ জন বিশ্বনেতা ও নোবেল বিজয়ী।

২৭শে আগস্ট একটি খোলা চিঠিতে এসব নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন তারা। এতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কমপক্ষে ১০০ ব্যক্তি।

চিঠিতে তারা লিখেছেন, মানবাধিকারের বিষয়ে একটি হুমকি আমাদেরকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে উদ্বিগ্ন করেছে। তা হলো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা। আমরা এ জন্য উদ্বিগ্ন যে, সাম্প্রতিক সময়ে তাকে টার্গেট করা হয়েছে, যেটাকে আমরা মনে করি অব্যাহত বিচারিক হয়রানি।

ইউনূস সহ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে মানবাধিকারের পক্ষের কর্মী এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির জন্য যেভাবে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে তাতে মঙ্গলবার উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন ইউনূস।

বর্তমানে তিনি দুটি মামলার মুখোমুখি, যাতে তার কারাদণ্ডও হতে পারে। এর একটি হলো শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ। অন্যটি দুর্নীতির অভিযোগ। তিনি আরও বলেছেন, আদালতে নিজে আত্মপক্ষ সমর্থনের যখন সুযোগ পাবেন ইউনূস, আমরা উদ্বিগ্ন যে, তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হবে, যা প্রায়শই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসে। আদালতে হাজির হলে তার সুষ্ঠু বিচারের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এমনকি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রক্রিয়াও অনুসরণের ঝুঁকি থাকবে।

তবে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এসব উদ্বেগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, দেশের বিচারিক কর্মকাণ্ডে বাইরের হস্তক্ষেপের জন্য এসব বিবৃতি দেয়া হয়েছে।

ইউনূসের আইনি সমস্যা কি?
ইউনূস ও বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক, যা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- তা অসহায় মানুষদের সাহায্যের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ হলো উন্নয়নশীল এলাকায় মানুষকে সহজ শর্তে দেয়া ঋণ। এই ঋণে তারা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন এবং তাতে এসব মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র নারীরা সহায়তা পান দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে।

১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন ড. ইউনূস। একে প্রথম আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার এই ধারণা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করার জন্য একে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ক্ষমতায় এসে ড. ইউনূসকে ‘রক্তচোষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান হিসেবে গ্রামের দরিদ্র নারীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ঋণের কিস্তি উদ্ধারে তিনি শক্তি ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড রিভিউ শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার। অবসরের বয়সসীমা সংক্রান্ত বিধি ভঙ্গের অভিযোগে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ইউনূসকে বরখাস্ত করা হয়। নোবেল পুরস্কার ও একটি বই থেকে রয়েলটিসহ সরকারের অনুমতি ছাড়া অর্থ গ্রহণের অভিযোগে ২০১৩ সালে বিচারের মুখোমুখি করা হয় তাকে। এরপর তার সৃষ্ট অন্য কোম্পানিগুলোতে জড়িত থাকায় তাকে অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে আছে গ্রামীণ টেলিকম, বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণ ফোন, নরওয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান টেলিকম জায়ান্ট টেলিনর।

কর্মক্ষেত্রে চাকরির বিনিময়ে যে লভ্যাংশ পাওয়ার কথা তা না দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরিয়ে ফেলেছেন এমন অভিযোগে গত মাসে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন সাবেক কর্মচারী। আলাদাভাবে, একই মাসে ড. ইউনূসকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি এবং অন্য ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তাদের অভিযোগ, এরা গ্রামীণ টেলিকমের অর্থ আত্মস্মাৎ করেছেন। তার আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, সব মিলে এখন পর্যন্ত প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে মোট ১৯৮টি মামলা হয়েছে।

ইউনূসকে কেন টার্গেট করেছেন হাসিনা?
বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকারের সময়ে নিজে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ড. ইউনূস। তখনই তার ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। তবে অল্প সময় পরেই এই অর্থনীতিবিদ তার পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তারপর থেকে রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রফেসর আসিফ নজরুল ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, সরকার আন্তর্জাতিকভাবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার প্রতিটির পিছনে ইউনূস আছেন বলে বিশ্বাস করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে আছে দেশের সবচেয়ে বড় সেতু বিষয়ক ঋণ বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাহার করে নেয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক চাপ। তিনি কেন এমনটা ভাবেন তা আমরা জানি না। কারণ, এখন পর্যন্ত সরকারের তরফে এসব অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ দেয়া হয়নি।

প্রফেসর ইউনূসের আইনজীবী আল মামুন মনে করেন, জটিল সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে উদ্ভাবক হিসেবে বিশ্বজুড়ে এই অর্থনীতিবিদের যে সুনাম আছে, তাকে অবমাননা করার জন্যই এসব মামলা করা হয়েছে। শ্রম আইনে তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা করার কোনো কারণ নেই। এটা সর্বোচ্চ হতে পারতো একটি দেওয়ানি মামলা। উপরন্তু তার বিরুদ্ধে তহবিল আত্মস্মাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাই করা হয়েছে সরকারের সরাসরি নির্দেশে।

গণতান্ত্রিকভাবে পশ্চাৎমুখী হচ্ছে বাংলাদেশ?
ডয়েচে ভেলেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নোবেল বিজয়ীকে হয়রানি করার জন্য এসব মামলা হয়নি। যারা অন্যায়ের শিকার হয়েছেন তারা আদালতে প্রতিকার চেয়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটা তাদের অধিকার। তিনি (ইউনূস) অন্যায় করেছেন কিনা তা নির্ধারিত হবে আদালতের বিচারে।

কিন্তু আসিফ নজরুল বলেছেন, দেশের আইনি ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে তার। তিনি বিশ্বাস করেন তদন্তকারী এজেন্সি, প্রসিকিউশন এজেন্সি এবং বিচারিক বিভাগের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে হাসিনা সরকারের। পদায়ন, ট্রান্সফার, ছুটি, ট্রায়াল জাজদের প্রমোশন রয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। তাই এসব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার ওপর খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে সরকার। তাদের সময়কাল যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই বিচারিক ব্যবস্থার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও বৃহৎ হবে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ভোট জালিয়াতি, বিরোধী নেতাকর্মীদের ভীতিপ্রদর্শনে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে শেখ হাসিনার সরকার। বিতর্কিত দুটি নির্বাচনেই তার দল বিজয়ী হয় এবং তিনি ক্ষমতায় থেকে যান। তবে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো অভিযোগ করেছে যে, ১৪ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর আইনপ্রয়োগকারী এজেন্সি এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা এই প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের কণ্ঠকে নিস্তব্ধ করে দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্বলিত অসংখ্য মামলা হয়েছে বিরোধী দলীয় অনেক নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজের সদস্য ও মানবাধিকারের পক্ষের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এর ফলে তাদেরকে বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয় আদালতকক্ষে অথবা জেলে।
(ডয়েচে ভেলে ইংরেজি সংস্করণ থেকে অনুবাদ)