নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয়ের অপেক্ষায় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা

নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয়ের অপেক্ষায় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা

ঘুমধুম এলাকাটি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। এর পাশেই মিয়ানমার সীমান্ত। সেখানে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। কিছুক্ষণ পরপরই পাওয়া যাচ্ছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষে প্রাণহানি এড়াতে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা দফায় দফায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। 

আজ সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম।

এরই মধ্যে আজ বিকেল পৌনে ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে দু’জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়েছে এক শিশুও।

নিহত নারী জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম (৪৫)। অপর নিহত নবী হোসেন (৭০) উখিয়া কুতুপালং ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। নিহত শিশুটি হোসনে আরা বেগমের নাতনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ এবং ঘুমধুম ফাঁড়ির ইনচার্জ মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া। তারা জানান, নিহত নারীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা পুরুষের মরদেহ ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন জানান, হোসনে আরা বেগম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড জলপাইতলীর এলাকার বাসিন্দা। আজ দুপুরে তারা রান্নাঘরে বসে ভাত খাচ্ছিলেন। তখন সেখানে মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে মর্টার শেল এসে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে তাদের প্রাণহানি ঘটে। 

এদিকে চলমান এ সংঘর্ষে ঘুমধুম এবং পালংখালী সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। এরমধ্যে অর্ধেক চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন। 

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী ও কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান।

গফুর উদ্দিন চৌধুরী তার একাধিক সোর্সের বরাত দিয়ে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে ঘুমধুম এবং পালংখালী সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় আছেন সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। এরমধ্যে অর্ধেক চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন বলে জানা গেছে। এছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা অথবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।’

অপরদিকে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।’

‘১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের মতো ছোট একটা দেশে এটি একটি বিরাট ঘটনা।’ মানবিক দিক বিবেচনা করে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো তাদের সাহায্য নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।

হাসপাতালে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৮ সদস্য

বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাতে দেশটির ৯৫ সীমান্তরক্ষী পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে আহতদের উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৮ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা হলেন- জা নি মং, নিম লাইন কিং, ক্যে থিন সিন, ইয়ো ফো, মং র, মুলিউন থং, কিন মং জ ও সন্তা অং। 

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও ) মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘বিজিপির আট সদস্যকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক হওয়ায় তিনজনকে আজ বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি থামছেই না 

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি যেন থামছেই না। কি স্থল কি আকাশপথ! সমানতালে চলছে গোলাগুলি। হেলিকপ্টার থেকে করা হচ্ছে গুলি আবার পাল্টা গুলি ছোরা হচ্ছে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে। একইসঙ্গে মর্টার শেলের বিকট শব্দে কাঁপছে তুমব্রু সীমান্ত।

ঘুমধুম সীমান্তের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে তুমব্রু রাইট বিওপি ও ঢেকুবুনিয়া ব্যাটালিয়ন এলাকায় মুর্হুমুহু গুলিবর্ষণ করেছে, যা ঘণ্টাব্যাপী চলে। আমরা সীমান্তের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে রয়েছি।

পশ্চিমকূল সীমান্তের বাসিন্দা রিয়াদ বলেন, বিজিপির তিন সদস্য বাংলাদেশে পালিয়েছে। তারা কয়েকটি পোশাক রাস্তায় ফেলে যায়। পরে পোশাকে দেখি বেশ কয়েকটি তাজা বুলেট। এতে চরম আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয় লোকজন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভূট্টো বলেন, তুমব্রু সীমান্তের তুমব্রু রাইট বিওপি নাকি বিদ্রোহী গোষ্ঠী দখলে নিয়েছে শুনেছি। পতাকাও টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এখন বিদ্রোহীরা ঢেকুবুনিয়া ব্যাটালিয়ন দখলে নিতে ব্যাপক গোলাগুলি করছে।

প্রসঙ্গত বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়।