রাজউকের অভিযান, ১২টি সিলগালা, গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে রুফটপ

এই ভবনের কোনো রেস্টুরেন্টের অনুমোদন ছিল না

এই ভবনের কোনো রেস্টুরেন্টের অনুমোদন ছিল না

ধানমণ্ডির ১৫ নম্বরে অবস্থিত ‘গাউসিয়া টুইন পিক’ নামের ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে। কিন্তু ভবনের পুরোটা জুড়ে স্থাপন করা হয়েছিল ১৫টি রেস্টুরেন্ট। বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এমন ভবনের বিষয় আলোচনায় আসে। ধানমণ্ডির এই এলাকায় ৫টি ভবনে অন্তত ৯৫টি রেস্তরাঁ রয়েছে এমন খবর প্রকাশ করেছিল মানবজমিন। খবর প্রকাশের পর গাউসিয়া টুইন পিকসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনে অডিযান চালিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস। অভিযানের পর রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে টুইন পিক ভবনে কোনো রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি ছিল না। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। অভিযানে ভবনটির ১২টি রেস্তরাঁ সিলগাালা করে দেয়া হয়। গুড়িয়ে দেয়া হয় রুফটপে থাকা একটি রেস্তরাঁ। এ ছাড়া ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টকে জরিমানাও করা হয়েছে।

অভিযান পরিচালনাকারী রাজউকের জোন ৩-এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার বলেন, ভবনটি রাজউক থেকে এফ ক্যাটাগরিতে অফিস করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এখানে এসে দেখছি, শুধুমাত্র দ্বিতীয় ফ্লোরের কিছু অংশ অফিস হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি ওষুধ ও কাপড়ের দোকানও পেয়েছি। বাকি অংশগুলোতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১২ থেকে ১৫টি রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেয়া হয়েছে। এই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টেরও অনুমোদন নেই।

তিনি বলেন, রাজউকের নকশায় স্পষ্টত এখনো দেখানো হচ্ছে ভবনের ছাদ খোলামেলা। কিন্তু ছাদেও রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা ছাদের রেস্টুরেন্ট ভেঙে দিয়েছি। একই সঙ্গে ১২টি রেস্টুরেন্ট সিলগালা ও ১টি রেস্টুরেন্টকে জরিমানা করা হয়েছে। আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি।

তিনি বলেন, রাজউক ছাড়াও সিটি করপোরেশন কিংবা কলকারাখানা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদেরকেও বিষয়টি অবগত করবো। নিয়মের ব্যত্যয় যারা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। 

একই সময়ে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ এলাকার কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ারে অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই ভবনে অভিযান চালানো হবে এমন খবরেই দ্বিতীয় তলা থেকে ওপরের দিকের সব রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ তালা লাগিয়ে চলে যায়। কথা বলার জন্য ভবন সংশ্লিষ্টদের ডাকা হলেও তারা কেউ আসেননি। বাধ্য হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠেন অভিযান সংশ্লিষ্টরা। এ সময় পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ার সিলগালা করে দেয়া হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে ৩ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপশি আটক করা হয় ৩ জনকে। অভিযান শেষে মূল গেটের সামনে নোটিশ টানিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় ভবনটির সকল রেস্টুরেন্ট। নোটিশে লেখা ‘সকল চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এবং খাবার হোটেল বন্ধ থাকবে। শুধু দ্বিতীয় তলার মার্কেট এবং নিচ তলার দোকানগুলো খোলা থাকবে। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।’

অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এই ৩টি সংস্থা মিলে আজ এই ভবনে অভিযান পরিচালনা করেছি। এতে অগ্নিঝুঁকি প্রতীয়মান হয়েছে। যদিও আগে থেকে রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অভিযানের সময় উপর তলা থেকে ভিসা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এডমিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছে, এমন দেখতে পাই। পরে এখান থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ইমন, টগন, রফিক নামের ৩ জনকে আটক করে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা বিধি অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছি এবং তারা সেই টাকা পরিশোধও করেছেন। বাকি মুচলেকা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের মুক্তি দেয়া হবে।

তিনি বলেন, মূলত, ধানমণ্ডি সাতমসজিদ রোডের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অনিয়ম পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।

এ সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা উত্তর (জোন-২) এর উপ-সহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলামসহ অন্যান্য ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টররাও উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়াও রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় আবাসিক ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গতকাল বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ইকবাল হোসাইনের নেতৃত্বে র‌্যাংকিং স্ট্রিটের ‘আই লাভ মেজ্জান’ রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখেন বিভিন্ন মালামাল রেখে কিচেনের পাশে ইমার্জেন্সি এক্সিট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বার্গার এক্সপ্রেসে ৪ ফুট বাই ৬ ফুট সাইজের কিচেনের ৭ থেকে ৮ জন শেফ কাজ করলেও নেই তেমন কোনো সেফটি ব্যবস্থা। শেফ টায়েফের এক্সিট পয়েন্টে তৈরি করা হয়েছে মোবাইল কোম্পানির শোরুম।

অভিযানের বিষয়ে ডিসি মো. ইকবাল হোসাইন বলেছেন, রোববার থেকে আমরা অভিযানে নেমেছি। বিশেষ করে আমাদের ওয়ারী থানার অধীনে র‍্যাংকিং স্ট্রিট অনেক ব্যস্ততম একটি জায়গা। এই একটি রাস্তায় মোর দ্যান ফিফটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই রেস্টুরেন্টগুলো ভিজিট করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, বেশিরভাগ রেম্টুরেন্ট আবাসিক ভবনের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে তারা এই রান্নার কাজগুলো চালাচ্ছে। আমরা ভিজিট করে দেখেছি সেফটি কোড, কিচেন কোড কোনোকিছুই তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। আমরা এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে আটক করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো। এর আগে রবিবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানী জুড়ে বিভিন্ন রেস্তরাঁয় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা বা যথাযথ অনুমতি রয়েছে কিনা সেগুলো খতিয়ে দেখেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অভিযানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অনিয়ম থাকার কারণে মোট ২৫ জনকে আটক করা হয়।

অপরদিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)এর অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও নজর রাখছে। যেসব রেস্টুরেন্টে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে এবং নিরাপত্তা নেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, মানুষ মারা যাওয়ার পর শোক করি, কান্না করি, জ্ঞান দেই। আসলে আমাদের প্রতিটি সংস্থার যে দায়িত্ব আছে, সেগুলো যদি আমরা পালন করতাম, তাহলে এমন ঘটনা হয়তো ঘটতো না। তাই এখন আমরা প্রতিটি রেস্টুরেন্টে খোঁজ নিচ্ছি। যেসব রেস্টুরেন্টে অনিয়ম রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।-মানবজমিন