জলদস্যুর কবলে জাহাজ

মুক্তিপণের আলোচনা তিন ধাপে, ভাগ পাঁচে

মুক্তিপণের আলোচনা তিন ধাপে, ভাগ পাঁচে

আনুষ্ঠানিক কিছু না জানালেও মুক্তিপণের পথেই হাঁটছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তারা গতকাল শনিবার প্রথমবারের মতো জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র জিম্মি ২৩ নাবিকের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে। মালিকপক্ষ ও স্বজনকে চাপে রাখতেই এমনটি করা হয়েছে– ধরে নিয়ে বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ এবং তারা পুরোনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মধ্যস্থতাকারী খুঁজছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের জিম্মি ঘটনায় মুক্তিপণের বিষয় তিন ধাপে আলোচনা হয়। জাহাজের মালিকপক্ষ যোগাযোগ করে বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বীমা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী ঠিক করে। তারা যোগাযোগ করে জলদস্যুর প্রতিনিধির সঙ্গে। তিন পক্ষ আলোচনা করে মুক্তিপণের অঙ্ক ও প্রদানের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। এরপর মুক্তিপণের অর্থ পাঁচ ভাগে ভাগ হয়। জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে তিন স্তরে ভাগ করে। এক ভাগ যায় মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের অর্থ পরিবহনকারী গ্রুপের কাছেও। ১৪ বছর আগে এ প্রক্রিয়াতেই ‘এমভি জাহান মণি’ জাহাজের নাবিকরা মুক্ত হয়েছিলেন।

এমভি জাহান মণির মুক্তিপণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম। এবারও তিনি জাহাজ মালিকের হয়ে বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য এ নিয়ে মালিকদের কেউ খোলামেলা কথা বলছেন না। তবে গতবার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কেএসআরএমের এক নীতিনির্ধারক জানান, গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা এগোচ্ছেন। জলদস্যুদের থেকে এখনও মুক্তিপণের দাবি আসেনি। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণে অনেকটাই নিশ্চিত, নাবিকদের মুক্ত করতে মুক্তিপণই লাগবে। এ জন্য বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা লন্ডনভিত্তিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এসব মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে জলদস্যুদের যোগাযোগ রয়েছে। সোমালিয়ায় একাধিক জলদস্যু গ্রুপ রয়েছে। ঠিক কারা এমভি আবদুল্লাহ কবজায় নিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরপরও সময়ক্ষেপণ এড়াতে সব ধরনের যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কেএসআরএমের মুখপাত্র ও মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিপণের অর্থ আদায় ও বণ্টনে একটি ছক রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এ ছকেই হাঁটছি। নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনাতেই আমাদের পূর্ণ মনোযোগ।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৌশলগত চাপ তৈরিতেই শনিবার দিনভর নাবিকদের কাউকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি দস্যুরা। আগেও তারা এ পথই অনুসরণ করেছিল।’

মুক্তিপণ আদায়ের প্রক্রিয়া
ভারত মহাসাগরে ২০০৫ সালের পর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের সংঘবদ্ধ আক্রমণ জোরদার হয়। তারা রাত কিংবা ভোরের দিকে বড় জাহাজের কাছে পৌঁছাতে দ্রুতগতির ছোট ছোট মোটরচালিত নৌকা ব্যবহার করে। এগুলো আবার বড় জাহাজের রাডারেও সহজে ধরা পড়ে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জিম্মিদের কাছ থেকে জলদস্যুরা ইউএস ডলারের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। এসব মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের জন্য দুটি পদ্ধতি পছন্দ তাদের। বস্তায় ভরে হেলিকপ্টার থেকে নির্ধারিত স্থানে ফেলে দেওয়া। অথবা ছোট নৌকায় করে ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে বুঝে নেয়। মাঝেমধ্যে প্যারাসুটের মাধ্যমেও মুক্তিপণ জলদস্যুদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। গোটা প্রক্রিয়া হয় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী সংস্থার মাধ্যমে। এদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।

ইইউ ন্যাভ ফর আটালান্টা বলছে, তারা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কিন্তু নাবিক জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের কৌশলের কাছে পরাস্ত হচ্ছে। এ জন্য জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হন জাহাজ মালিকরা। জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘জাহাজ জলদস্যুদের কবজায় পড়ার পর গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রথমে দ্বারস্থ হতে হয় বীমা কোম্পানির। তারাই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে আসা বার্তা বীমা কোম্পানির মাধ্যমে জাহাজ মালিক জানতে পারেন। এভাবে তিন পক্ষ মুক্তিপণের অর্থ চূড়ান্ত করে।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জলদস্যুরা ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করলেও ভোগ করে কয়েকটি পক্ষ। মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের অর্থ পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত পরিবহন সংস্থাও একটি অংশ পায়। মূলত অর্থ তিন ধাপে ভাগ করে জলদস্যুরা। প্রথমে যারা জাহাজে ওঠে, তাদের নির্ধারিত অংশ বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়। এ দল ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পায়। বাকি অর্থ দ্বিতীয় ধাপে যারা জাহাজটি পাহারা দেয়, তাদের দেয়। জাহাজের জ্বালানি, খাওয়া-দাওয়াসহ পরিচালনাগত খরচ আলাদাভাবে হিসাব করে জলদস্যুরা। এমভি জাহাজ মণির ক্ষেত্রে আমরা এমন ভাগবাটোয়ারা জেনেছি।’

জানা গেছে, লুটের টাকা দিয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুরা পরিচালনা করে নিজস্ব স্টক এক্সচেঞ্জও। অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে এ স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়, অভিযান সফল হলে পাওয়া যায় লভ্যাংশ! বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বিনিয়োগকারী এ স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এক মাসে ৭৫ হাজার ডলারও উপার্জন করেছেন।

কেন ঘাঁটি ভারত মহাসাগরে
নৌ বাণিজ্য অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ জানান, সোমালিয়ার উপকূলসংলগ্ন সমুদ্রপথ বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম রুট। এডেন উপসাগরের এক উপকূলে ইয়েমেন; অন্যদিকে সোমালিয়া, জিবুতি, ইরিত্রিয়া। এ অঞ্চলে জলদস্যুদের উৎপাত বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। ২০১০-১১ সালে মাত্রা ছাড়ায় জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য। সম্প্রতি আবারও আলোচনায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। লোহিত সাগরে হুতিদের নিয়ে অন্যান্য দেশ ব্যস্ত থাকায় ভারত মহাসাগরের আশপাশে মাথাচাড়া দিচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তারা একে-৪৭, একেএম, টাইপ-৫৬, টিটি-৩৩, পিকে, আরপিজি-৭ ও রকেট লাঞ্চারের মতো অস্ত্রও ব্যবহার করছে। এসব ব্যবহারে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে, তা জাহাজ জিম্মি করে মুক্তিপণের অর্থে পুষিয়ে নেয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউ ন্যাভ ফর আটালান্টার মতে, গত বছর নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত ১৪টি জাহাজ দস্যুরা কবজায় নিয়েছে। গত জানুয়ারিতে সোমালিয়ার দস্যুদল ১৭ নাগরিকসহ ইরানের পতাকাবাহী একটি জাহাজ অপহরণ করে। একই মাসে ইরানের পতাকাবাহী আরেকটি মাছ ধরার জাহাজে আক্রমণ করে জলদস্যুরা ১৯ ক্রুকে জিম্মি করে। পরে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সুমিত্র তাদের উদ্ধার করে।

বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।