'বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনায় কতটা আইনি প্রতিকার পায় পরিবারগুলো?

'বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনায় কতটা আইনি প্রতিকার পায় পরিবারগুলো?

ঢাকা, ৩ জুন (জাস্ট নিউজ) : বাংলাদেশে অনেক সময়েই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ধরে নিয়ে হত্যার অভিযোগ তোলেন নিহতদের স্বজনেরা।

সম্প্রতি বাংলাদেশে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে যে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে, তাদের অনেকের পরিবারও এ ধরণের অভিযোগ তুলেছেন।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কক্সবাজারের টেকনাফে র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা মো. একরামুল হকের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের প্রকাশ করা অডিওটি সংগ্রহ করে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তদন্তের প্রক্রিয়াগুলো কী? কতটাই বা প্রতিকার পায় এসব ভিকটিমদের পরিবার?

বিচারহীনতার পরিবেশ
২০১৪ সালে র‍্যাবে হাতে আটক এবং নির্যাতনে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শাহিনুর আলম মারা যায় বলে তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ। বিচার চেয়ে তারা আদালতেও গিয়েছেন, কিন্তু এরপর থেকেই আদালতের দ্বারে ঘুরছেন শাহিনুরের ভাই মেহেদি হাসান।

মেহেদি হাসান বিবিসিকে বলেন, “আমার ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ভৈরবের র‍্যাব ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখানে ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে থানায়, পরে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে কয়েকদিন পরে ভাই মারা যান।”

তিনি বলেন, “এরপর আমরা আদালতে একটি অভিযোগ করি। ম্যাজিস্ট্রেট থানা পুলিশকে আদেশে দেন যেন সেটি এফআইআর বা নিয়মিত মামলা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় আর সেই আদেশটি স্থগিত করে দেয়া হয়।”

“এরপর আমরা হাইকোর্টে একটি রিট করে আমাদের পক্ষেই রায় পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই আদেশও স্থগিত হয়ে যায়। এরপর থেকে দিনের পর দিন আমরা বিচারের জন্য ঘুরছি।”

“আমার ভাই যদি অপরাধী হয়, তাহলে বলুক কি তার অপরাধ? না হলে যাদের নির্যাতনে আমার ভাই মারা গেল, তাদের বিচার হোক,” বলছেন মেহেদি হাসান।

অনেকটা একই ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুরের খালাসী ভাইদের বন্দুকযুদ্ধ আর ঝালকাঠির লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করার ঘটনায় করা মামলার ক্ষেত্রে।

লুৎফর খালাসীর সন্তান বাবলু খালাসী বলছেন, “প্রথমে আমরা মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ভয় দেখানো হয়েছে, যে মামলা করলে আরো ক্ষতি হবে। তাই আর কোন মামলা করিনি।”

তবে তাদের পক্ষে একটি রিট করেছিল আইন ও শালিস কেন্দ্র। সরকারকে কারণ দর্শানো হলেও বেঞ্চ ভেঙ্গে গেলে সেই রিটের আর কোন আদেশ আসেনি।

আর লিমনের মায়ের করা মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে।

যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে বরাবরই জানানো হয় যে, যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

কিন্তু অপারেশন ক্লিন হার্ট থেকে শুরু করে পুলিশ বা র‍্যাবের যেসব কথিত বন্দুক যুদ্ধ বা বাহিনীর সদস্যদের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার কোনটিরই কোন সাজার নজির জানা নেই আইনজীবী বা মানবাধিকার কর্মীদের।

আইনি প্রতিকার কোথায়?
র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলছেন, “প্রতিটি বন্দুক যুদ্ধের ঘটনার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে সেই ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হয়।”

আইন অনুসারে, পুলিশ বা র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনার পর একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেটি তদন্ত করে দেখেন। তার প্রতিবেদনের ওপর সেটির গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে।

কিন্তু কোন ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটি নিয়ে কি আলাদাভাবে তদন্ত করা হয়?

র‍্যাব কর্মকর্তা বলছেন, “সেটার আসলে তো কোন দরকার নেই। তদন্ত তো একবার হচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তেই তো কোন সমস্যা থাকলে বেরিয়ে আসবে।”

“অনেক পরিবার দাবি করে, তাদের স্বজনরা নিরপরাধ। এমনকি জঙ্গিদের পরিবারের সদস্যরাও সেরকম দাবি করতো। কিন্তু আসলে দেখা যায়, অনেক সময় পরিবারের সদস্যরাও তাদের অপরাধের বিষয়ে জানেন। আমরা যেসব অভিযান করি, যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই অভিযান পরিচালনা করা হয়।” বলছেন মি. খান।

কথিত বন্দুক যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসরণের একই দাবি করেছে পুলিশও।

সেসব তদন্ত সন্দেহ দূর করতে পারেনি মানবাধিকার কর্মী আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর।

বাংলাদেশের আইন অনুসারে এর জন্য থানায় বা আদালতে মামলা করতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। সেখানেও সন্তুষ্ট না হলে তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারে। যদিও এরকম আইনি ব্যবস্থা নেয়ার প্রবণতা খুবই কম।

এরকম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছেন গবেষক নুর খান লিটন।

তিনি বলছেন, “খুব কম সংখ্যক মানুষ বিচার প্রার্থনা করেন। কারণ একটা ভয়ার্ত পরিবেশে এক ধরণের মানসিক চাপ এবং অজানা আশংকা থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিতে সাহস পান না।”

“তারপরেও যে দুই চারজন মানুষ আইনি লড়াই করার চেষ্টা করেন, প্রথমত থানা তাদের মামলাগুলো গ্রহণ করে না। কখনো গ্রহণ করলেও, সেটার ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেয়া হয়। তারপরে তারা জজ কোর্ট, হাইকোর্টে যান। একপর্যায়ে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণের পর তারা হতাশ হয়ে যান অথবা পারিপার্শ্বিক নানা চাপের কারণে এই বিষয়ে আর লড়াই করতে চান না।” বলেন মি. খান।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনাগুলো তদন্ত করার কথা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হলেও, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ্যে আসে না। তদন্তের ভার অনেক সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওপর থাকায় আসল চিত্রটিও জানা যায়না।

ফলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগটি সবসময়েই থেকে গেছে।

এসব ঘটনায় একটি নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী সুলতানা কামাল।

তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে অনেকবারই সুপারিশ ছিল যে, তদন্ত টিমের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী বা নাগরিক সমাজ থেকে বিশ্বাসযোগ্য অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে এটা মানুষের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, তদন্তটা সুষ্ঠু হয়েছে এবং নিরপেক্ষ হয়েছে।

এখন কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনাগুলোর যেসব তদন্ত হচ্ছে, তার প্রতিবেদনগুলো জনসম্মুখে প্রকাশের আহবান জানাচ্ছেন সুলতানা কামাল।

বাংলাদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া মাদক বিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে।

টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হকের স্বজনরা দাবি করেছেন, যে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং সে ঘটনার একটি অডিও রেকর্ডও পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

এখন সেই ঘটনার তদন্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মানবাধিকারকর্মীসহ অনেকেই। সূত্র: বিবিসি