শেখ হাসিনা, আইয়ুব খান: দুই স্বৈরশাসকের মিল অমিল

শেখ হাসিনা, আইয়ুব খান: দুই স্বৈরশাসকের মিল অমিল

ব্যারিষ্টার এম এ আরেফিন আশরাফ

শেখ হাসিনা এবং ১৯৬৯-এর মার্চে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের মধ্যে একটি জায়গায় রয়েছে অদ্ভুত মিল। এ বাক্য পড়েই হয়ত কেউ পরের বাক্যের জন্য আন্দাজ করে বলবেন - এই দু'জন একি কায়দায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। এই মতের সাথে সঙ্গে আমি সম্মানের সাথে দ্বিমত পোষণ করি।

এই দু'জন নিয়ম বিরোধী নীতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, কিন্তু তাদের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কায়দা এবং প্রেক্ষাপট এক রকম নয়। জেনারেল আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন রাজনৈতিক ব্যর্থতা মোটামুটি চরম পর্যায়ে ছিল এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা খবুই নড়বড়ে ছিল।

রাজনীতিবিদদের রেষারেষি আর বারবার ব্যর্থতার কারণে তদানীন্তন জনগণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য শাসন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই কিছু চেয়েছিল। আইয়ুব খান সেই সুযোগই নিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা দখলে সাধারন জনগণ ও রাজনীতিবিদদের একাংশেরও সমর্থন ছিল। ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এরকমই ইঙ্গিত করে।

পক্ষান্তরে, জনশ্রুতি রয়েছে যে ১/১১-এর পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে বলা যায় এই ব্যাপারে চাক্ষুষ কোনো দলিল এখন পর্যন্ত নেই। কিন্তু, আমি বলব প্রমাণের সময় এখনো অতিবাহিত হয়নি কেননা আওয়ামী লীগ এখনও টানা ক্ষমতায় এবং সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে, এখানে দ্বিতীয় কারো পক্ষে কোন প্রমাণ হাজির করা অসম্ভব আমাদের দেশের পরিবেশে। এর পরে, অন্তত ২০১৪ সাল থেকে, শেখ হাসিনার ক্ষমতা দখলে রয়েছে ধোঁকাবাজি এবং প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস করা।

যেমন, প্রথমত, তিনি গণতন্ত্রের আবরণে তথাকথিত ভোটের আয়োজন করে জনগণকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতা দখল করে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের অবতারণা করেছেন। ২০১৮ সালের অবস্থাতো আরো করুণ! এই ভোটে আগের রাতে ভোট দেয়ার ব্যবস্থাও ছিল এবং বিরোধীদের নিপীড়নের চিত্র সবার জানা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখতে গিয়ে পাঠকের বিরক্তির কারণ হতে চাইনা। কথিত এ সকল ভোটের নাটকে জনগণের সঙ্গে রয়েছে সুস্পষ্ট প্রতারণা, কেননা জনগণ তাদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ পায়নি অথবা ভোটের সঠিক প্রতিফলন হয়নি।

দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার ক্ষমতা দখলের পূর্বে বিএনপি দুই বার এবং আওয়ামীলীগ একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল করেছিল। সুতরাং, তার ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিবিদরা সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ ছিলেন এরুপ বলা যাবেনা।

পরিশেষে বলা যায় যে, শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের আবরণে রয়েছে পরিষ্কার প্রতরণা এবং প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ধ্বংস করা। অপরদিকে, জেনেরাল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল অবৈধ হলেও তাতে প্রতারণা এবং প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ধ্বংসের উপাদান নেই।

এবার আসি এই দুই স্বৈরশাসকের এক জায়গায় একটি অদ্ভুত মিলের প্রশ্নে। ১৯৫৮ সনে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন অর্থাৎ শিল্প উৎপাদন ১৬০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিলো (সূত্র: দি লাস্ট ডেইজ অফ ইউনাইটেড পাকিস্তান, জি. ডাব্লিউ. চৌধুরী, পৃষ্ঠা -১৫)। এই কথিত কাগুজে উন্নয়ন এবং শিল্প বিপ্লবের ফাটা বাঁশি বাজানোর জন্য একদল লোক সর্বদা ব্যস্ত ছিল। এই চাটুকারদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পরে প্ৰধানমন্ত্ৰী মৃত জুলফিকার আলী ভুট্টো। জনাব ভুট্টো ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খানের বিদেশ মন্ত্রী। এই তোষামোদকারী দলের অন্যতম কাজ ছিল কাগুজে উন্নয়নের ফাটা বাঁশি বাজিয়ে আর মিথ্যা বুলিতে আইয়ুব খানের স্বৈরতন্ত্র থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। কিন্তু, একটা আশ্চর্যের বিষয় হল ১৯৭০ সালের পরের দিকে এসে দেখা গেলো পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের তথা বর্তমান বাংলাদেশের জনগনের মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান ছিল শতকরা ৬১% যা ছিল বাংলার জনগণের সঙ্গে ভয়ংকর পর্যায়ের অর্থনৈতিক বৈষম্য (সূত্র: উপরে দেখুন)।

বলে রাখা ভাল যে, উন্নয়নের যে ফিরিস্তি আমাদের কে দেয়া হয় তা হয়ত কাগজে কলমে ভুল নয় কারণ একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ের উপর হিসেব নিকেশ করে হয় এখানে ছল চাতুরির করার খুব বেশি সুযোগ নেই।

তার মানে বুঝা যায় যে, উন্নয়ন হলেও তার সুফল সাধারণ মানুষদের কাছে পৌঁছায়নি বা অন্তত বাংলার জনগণের কাছে আসেনি। এক কথায় বলা যায় যে, উন্নয়ন অর্জিত সম্পদের সুষম বন্টন হয়নি। আইয়ুব খানের স্বৈরতন্ত্রে সমগ্র পাকিস্তানের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল কথিত ২২ পরিবারের মধ্যে যার অধিকাংশই আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সক্রিয় ছিল। তাই পরিষ্কারভাবেই বলা যায় যে, আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্রে দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হয়নি বরং কেবলমাত্র স্বৈরতন্ত্রের ভাগিদারদেরই উন্নতি হয়েছে।

এবার আসুন বাংলদেশের বর্তমান সরকারের উন্নয়নের প্রশ্নে। আইয়ুবের সময়ের চাটুকারদের মত বর্তমান শাসকদলের এবং ভারপন্থী প্রগতিশীলদের চাটুক্তি শুনতে শুনতে আমরা জনগণ হাঁফিয়ে উঠেছি। চারদিকে রব উঠেছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে উন্নীত হওয়ার পথে অগ্রসরমান। টিভি, পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই উন্নতির মহাসড়কের গাল-গল্প শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্তপ্রায়। পূর্বসূরীদের মত এরাও উন্নয়নের ফাটা বাঁশি বাজিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র থেকে থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য চেষ্টারত।

বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী বাংলদেশের জনগণের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩১ জন দৈনিক ২ ডলারের কম উপার্জন করে এবং ১২ জন অতিশয় দরিদ্র। অর্থাৎ এই ১২ জন মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম।

এতো গেলো বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব। এবার ফিরে আসি আমাদের দেশীয় বাস্তব চিত্রে। আমাদের দেশে নিম্নবিত্তের মানুষদের উচ্চবিত্তের দারস্ত হওয়ার পথ বরাবরই ক্ষীণ। কারণ উচ্চবিত্তের লোকেরা সাধারণত দান খয়রাত ও সাহায্য সহযোগিতা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এজন্যই যারা মধ্যবিত্ত তাদের সাথে সাধারনত দৈনন্দিন জীবনে নিম্নবিত্তের সঙ্গে যোগাযোগ বেশি থাকে এবং তাদের কাছেই সাহায্য সহযোগিতার জন্য নিম্নবিত্তের লোকেরা বেশি আসে।

বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বাস্তব চিত্র দেখার জন্য বেশ কয়েকটি অঞ্চলের ২০টি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদের সাথে কথা বলেছি। এই তালিকাতে আমার মা-ও রয়েছেন। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীই বলেছেন ২০১০ সালে সপ্তাহে ১/২ জন লোক সাহায্যের জন্য আসত যা ২০১৫/২০১৬ সালের দিকে ৩/৪ জনে উন্নীত হয় এবং ২০২০ সালে ৪/৫ জনে এসে পৌঁছেছে। এছাড়াও কৃষি জমির দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই আলোচনায় এবং সরজমিন পর্যবেক্ষণে এটা স্পষ্টরুপে প্রতীয়মান যে ২০১০ সালের তুলনায় অভুক্ত এবং মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেনা এমন লোকের সংখ্যা ২০০ গুণের উপরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ভাতের অভাবে সন্তান বিক্রি, প্রতিমার দিকে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষার আকুতি এবং খাওয়ার অভাবে আত্মহত্যার ঘটনা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যা পত্রপত্রিকা ঘাটাঘাটি করলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

সুতরাং, হাসিনা সরকারের উন্নতি সাধারণ মানুষের উন্নতি নয়। তাদের উন্নতি কেবলমাত্র সালমান এফ রহমানদের এবং তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার সহযোগীদের উন্নতি। এই জায়গায় জেনেরাল আইয়ুব এবং শেখ হাসিনার মধ্যে এক অদ্ভুত মিল রয়েছে।

লেখক

ব্যারিষ্টার এম এ আরেফিন আশরাফ
পিএইচডি গবেষক, কিংস্টন ইউনিভার্সিটি, লন্ডন

 

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজ বিডি ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।