শেখ হাসিনার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে

শেখ হাসিনার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তিনি (হাসিনা) কোনো ধরনের নির্বাচনী বৈধতা ছাড়াই ক্ষমতায় বসে আছেন বলা যায়। ২০১৪, ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জালিয়াতি করেছে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছে, মিডিয়ার কন্ঠ রুদ্ধ করেছে, আড়িপাতা যন্ত্র দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, টার্গেট এবং শক্তি প্রয়োগ করে সরকার ইচ্ছে করেই ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং দেশটিতে হতাশার এক বিস্তৃত পরিসর তৈরি করেছে।

ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমস-এ প্রকাশিত এক অভিমতে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের একদলীয় শাসন, স্বৈরাচারিতা, অর্থনৈতিক ঝুঁকি আর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এ মন্তব্য করেছেন লেখক অভিনাশ পালিওয়াল।

লেখক পালিওয়াল সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে শিক্ষকতা করেন। এর পাশাপাশি তিনি 'মাই এনিমি'স এনিমি: ইন্ডিয়া ইন আফগানিস্তান ফ্রম দ্য সোভিয়েত ইনভ্যাসন টু দ্য ইউএস উইথড্রয়াল' বইয়ের লেখক।

'দ্য গ্রাউন্ড আন্ডার শেখ হাসিনা'স ফিট ইজ শিফটিং' শিরোনামের এই অভিমতে পালিওয়াল বলেছেন, হাসিনার চ্যালেঞ্জ কিন্তু তার পরিচিত বিরোধী যারা তারা নয়। এই অস্পষ্ট পক্ষগুলো তার সুরক্ষিত রাষ্ট্রের ভিতরেই। আর রয়েছে তার দলে যারা এতপরিমাণ লাভ করেছে যে ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভাবতেই ভয় পায়।

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য অভিমতটির বাংলা অনুবাদ নীচে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন গত মাসে ভারত সফরে এসেছিলেন রাজনৈতিক দেন-দরবার করতে। সেসময়টাতে সিলেট এবং আসামে ভয়বাহ বন্যা শুরু হয়। প্রকৃতিও একটা বার্তার জানান দিল যে- ভারতের নিকটবর্তী পূর্বদেশটাতে সবকিছু ঠিক-টাক নেই। সাম্প্রতিক পদ্মাসেতু উদ্বোধন করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ঝলক দেখানো, ইসলমাপন্থীদের ধর-পাকড়, বড় দেশগুলোর বৈরিতায় পক্ষ নেয়ার ক্ষেত্রে চালাকি দেখানোর মতো বিষয়গুলোকে বাদ দিলে বাস্তব যে চিত্রটা একইভাবে সামনে চলে আসে তা হলো- শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিকতা, তিক্ত রাজনৈতিক মেরুকরণ আর বিপর্যকর অর্থনৈতিক অবস্থা।

ভারত সরকারের এক কর্মকর্তা আমাকে এ বিষয়ে বলেছেন- হাসিনা একটা তাসের ঘর বানিয়ে বসেছেন। বাংলাদেশ সরকারের এক কর্মকর্তাও একথাতে সায় দিয়েছেন।

অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক এই তিন ক্ষেত্রেই হাসিনার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বিষয়টিকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলার সুযোগটুকু যেমন কম, তেমনি দ্রুততার সঙ্গে বিবেচনা না করলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে-এটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচন হবার কথা আর ২০২৪ সালে বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধের চাপ শুরু হয়ে যাবে। স্থিতিশীল অবস্থার (দেখানোর জন্য) যে চাকচিক্য দেয়াল দেখানো হচ্ছে সেটা জৌলুস হারানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কথিত তাসের ঘরটি যদি ভেঙে না পরে তাহলে আসন্ন বছরগুলোতে সে ঘরটার জায়গা হারানো আশঙ্কা বাড়ছে। এটা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যেটুকু প্রত্যাশার জায়গা আছে তাকেও ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

আভ্যন্তরীণভাবে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার চলতি রাজনীতির মেরুকরণে দুইটি তিক্ততার তৈরি করেছে। প্রথমত, তিনি (হাসিনা) কোন ধরনের নির্বাচনী বৈধতা ছাড়াই ক্ষমতায় বসে আছেন বলা যায়। ২০১৪, ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জালিয়াতি করেছে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছে, মিডিয়ার কন্ঠ রুদ্ধ করেছে, আড়িপাতা যন্ত্র দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে, টার্গেট এবং শক্তি প্রয়োগ করে তারা ইচ্ছে করেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং হতাশার এক বিস্তৃত পরিসর তৈরি করেছে।

হাসিনার বাবা একদলের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পর ব্যর্থ হয়েছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে। কিন্তু  অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে এক ধরনের বাজি ধরেছে হাসিনা। একটা কথা এই বলে প্রচার করা হচ্ছে যে- শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার নেতৃত্বে একদলের শাসন ব্যবস্থায় তা স্থিতিশীলতা পাবে। দ্বিতীয় ভুলের শুরুটা হয়েছে এখান থেকে। জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ২১.৮%, আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৪%, বৈদেশিক রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে কমছে, পোশাক রপ্তানির রাজস্ব এবং রেমিটেন্স আয় কোষাগারের খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেনা।

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির এ অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার দায় রয়েছে। মোমেন কেন ভারতকে বাংলাদেশের পাট থেকে কর সরিয়ে নিতে দাবি জানাচ্ছে তার কারণটা এখানে স্পষ্ট। বাংলাদেশের জটিল অবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অবকাঠামোগত খাতের জন্য চড়া মূল্যে ঢাকার ঋণ নেয়াটা দায়ী। আর এটি ঋণ পরিশোধ করাকে কঠিন করে তোলছে। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে রুপপুর পারমাণবিক চুল্লির জন্য ২০১৫ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। অথচ খুদানখুলামে একই চুল্লি নির্মাণে ভারতের লেগেছে ৩ বিলিয়ন ডলার।

ঢাকা কেন এই ধরনের চুক্তি করলো তাহলে? কারণ, দেশের বাইরের ঋণের টাকায় সীমিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, দুনীর্তির চক্র আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধোঁয়াশাকে চাঙ্গা করে রাখা যায়। স্পষ্ট এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে এটা বলাই যায় যে- বাংলাদেশের অর্থনীতির যে অর্জন সেটা স্বীকৃতি দেবার চাইতেও একটু বেশী প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু দুর্নীতি চালু রেখে সেটাকে গণতন্ত্রের অংশ দেখানো এবং অর্থনীতির মিরাকলের কথা যেটা বলা হয় সেটা- এক ধরনের লম্বা কথা ছাড়া কিছুই না। আভ্যন্তরীণ এবং বাহিরের নানা কারণেই এই মিরাকল ঘটার সুযোগ নেই। নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলেও হাসিনা জনগণকে এ কথা বলে সহানুভূতি আদায় করতে চায় যে- বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থীরা দুটোই তার পথে মারাত্মক রকমের চ্যালেঞ্জ।

হাসিনার চ্যালেঞ্জ কিন্তু তার পরিচিত বিরোধী যারা তারা নয়। এই অস্পষ্ট পক্ষগুলো তার সুরক্ষিত রাষ্ট্রের ভিতরেই। আর রয়েছে তার দলে যারা এতপরিমাণ লাভ করেছে যে ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভাবতেই ভয় পায়। এবিষয়টা হাসিনাকে একধরনের অস্বস্তির দ্বন্দে আটকে ফেলেছে। হয় তাকে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে এবং ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে নতুবা নির্বাচনে জালিয়াতে করতে হবে। যেটি কীনা আন্তর্জাতিক মহলকে অসন্তুষ্ট করবে। এর পরিণতিতে গণ বিক্ষোভ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষমতার পালাবদলের সুনির্দিষ্ট কোন পথ না থাকার কারণে সরকার বদলের সুযোগ নিতে পারে সুযোগসন্ধানীরা। দুর্ভাগ্যবশত যেটার সমৃদ্ধ নজির বাংলাদেশে রয়েছে।

বাইরের দেশের প্রতি নির্ভরশীলতা হাসিনার আভ্যন্তরীণ সমস্যার একটি। দেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আস্থা ফেরাতে নয়াদিল্লীকেন্দ্রিক আস্থাশীল হাসিনার ভারত কেন্দ্রিক সুবিধা বাগানো কঠিনতর হচ্ছে। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং রোহিঙ্গা সংকট এদুটো তার কাজকে জটিল করছে। একইভাবে, চীন থেকে টাকা নিয়েও রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবেনা কারণ র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঢাকাকে কোনঠাসা করে রেখেছে। সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির যুক্তরাষ্ট্র সফরের রেশে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে বদল করা হয়। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতিতে খুব একটা ওদল-বদল হবেনা।

এসব সমস্যার বাইরে, রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাবার বিষয়টি জোরালো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের এ অবস্থানে সন্তুষ্ট নয়। এপরিস্থিত আরও নাজুক আকার ধারণ করতে পারে। আসন্ন যে সংকট চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, যেটা কীনা সহিংস হয়ে উঠতে পারে সেটা থেকে মুক্তি পেতে হাসিনার প্রয়োজন এ পথ থেকে বের হবার একটা রাজনৈতিক রাস্তা খোঁজা। এই ভারত উপমহাদেশ বাংলাদেশে সর্বশেষ যেটা প্রত্যক্ষ করবে সেটা হল- বিপর্যয়।

এনএম/