সরকার রওশন এরশাদকে ‘পয়জন’ হিসেবে ব্যবহার করছে: জি এম কাদের

সরকার রওশন এরশাদকে ‘পয়জন’ হিসেবে ব্যবহার করছে: জি এম কাদের

জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্ব ও রাজনীতির প্রশ্নে সরকার রওশন এরশাদকে ব্যবহার করছে। এমনটি মনে করছেন, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির স্বকীয় রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রশ্নে ‘ভিন্ন অবস্থান’ নিলে এবার রওশন এরশাদের ব্যাপারেও কঠোর হবে দল। এমনকি দলে ভাঙনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও তা করার ঘোষণা দিয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

গত বুধবার বনানীতে জাপার চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ময়মনসিংহ জেলার উপজেলা প্রতিনিধি সভায় জি এম কাদের এ ঘোষণা দেন।

এ ঘোষণার এক দিন পর আজ বৃহস্পতিবার জাপার সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা পান জি এম কাদের। আজ দুপুরে বনানীর কার্যালয়ে দলের প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের এক যৌথ সভায় জি এম কাদেরকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়। জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার ও কাজী ফিরোজ রশীদসহ ৩৯ জন উপস্থিত ছিলেন বলে দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ ছাড়া সভায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে কর্মিসভা করার সিদ্ধান্ত হয়।

এমন সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করেন দলের কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, ‘এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। ওনাকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যাতে দল ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা যায়।’

আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যখন রওশন এরশাদকে নিয়ে জাপার ভেতরে-বাইরে ভিন্ন রকম তৎপরতা চলছে, তখন জি এম কাদের দলের সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পেলেন।

অবশ্য গত বুধবার বনানীতে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রতিনিধি সভায় এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন জি এম কাদের। সেখানে তিনি মন্তব্য করেন, বর্তমান সরকার রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভেতর একটা ‘পয়জন’ (বিষ) হিসেবে ব্যবহার করছে। পার্টিকে ধ্বংস করতে তাকে আর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
জি এম কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে জনগণের চাওয়া-পাওয়া কী। আমরা ভালো সংগঠন চাই, ভালো প্রার্থী চাই। জনগণ আস্থা রাখার মতো একটি দল চায়। দলের শক্তশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে, গ্রহণযোগ্য রাজনীতি থাকতে হবে। আরেকটা হলো, জনগণ ভোট দেওয়ার অধিকার চায়। আমাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব, গ্রহণযোগ্য রাজনীতির প্রতি মানুষের সহানুভূতি আছে; কিন্তু আস্থা নেই।’

জাপার চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা বক্তব্য দিচ্ছি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমরা আমাদের দাবিদাওয়া সর্বস্তরে জানিয়েছি যে মানুষের ভোটাধিকার থাকতে হবে। বিদেশিরা এটার ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখছে। সামনের দিকে এটার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হবে, অচিরেই হবে। এটার কারণেই সব বিষয়ে একটি অনিশ্চয়তা।’
জি এম কাদের বলেন, ‘ভোটটা ঠিকমতো হবে কি না, এবং ভোট ঠিকমতো না দিয়ে সরকার থাকতে পারবে কি না, এটাকে সারা দেশের মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে—এটা নিয়ে অনিশ্চয়তা। এটা নিয়ে সংঘাত হতে পারে, সংঘর্ষ হতে পারে, রক্তারক্তি হতে পারে, অনেক কিছুই হতে পারে।’

জাপার চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের একক নেতৃত্ব এবং গ্রহণযোগ্য রাজনীতি, এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে। একক নেতৃত্ব আমাদের আছে—যেটা আইনগতভাবে (দলীয় গঠনতন্ত্র) সম্পূর্ণ একক নেতৃত্ব। সেখানে কারও কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। একটু আগে চুন্নু (মহাসচিব মুজিবুল হক) বিস্তারিতভাবে বলেছেন। তারপরেও বিভিন্ন জায়গায় প্ল্যাকার্ড লাগানো হচ্ছে (রওশন), সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে, বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। তারা আমাদের নাম ব্যবহার করছে। এই একটা জিনিসকে শেষ করতে হবে।’

রওশন এরশাদ প্রসঙ্গে জি এম কাদের বলেন, ‘ওনাকে আমরা সম্মান করি। উনি আমাকে অনেকবার বলেছেন তোমার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ভালো চলছে। তুমি কোনো সময় মনে করবে না, আমি এর বাইরে কিছু করব। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, উনি শারীরিকভাবে সক্ষম নন এবং অনেক ক্ষেত্রে জিম্মি হয়ে গেছেন। অনেকের কাছে অসহায়, কিছু করার নেই।’

‘এই পরিস্থিতিতে সরকার একটা সুযোগ নিচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ এটার সুযোগ নিয়ে ওনাকে আমাদের ভেতর একটা পয়জন হিসেবে ব্যবহার করছে। আমরা আমাদের রাজনীতি বলে যাই, উনি হঠাৎ একটা স্টেটমেন্ট করেন, এটা সরকার করাচ্ছে, আওয়ামী লীগ করাচ্ছে।... উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, দলের মধ্যে ঐক্য নেই, দল বিভক্ত, মানুষের আস্থা হারিয়ে দেওয়া।’

হুঁশিয়ারি জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, উনাকে (রওশন এরশাদ) আমরা সম্মান করি। কিন্তু রাজনীতিতে আমি আর কোনো আপস করব না। ওনার এই অবস্থান জাতীয় পার্টিতে আর হবে না। এটা না হলে আমরা হেলদি লাইফ লিড করতে পারব না। জাতীয় পার্টিকে যদি সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করতে হয়, আগে আমাকে রোগমুক্ত হতে হবে। বারবার এই পয়জন ঢুকিয়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং আমাদের ব্লিডিং করা হচ্ছে, আমাদের গৃহপালিত বিরোধী দল করছে। তার একমাত্র কারণ ওনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

জি এম কাদের বলেন, ‘কাজেই বৃহত্তর স্বার্থে, পার্টির স্বার্থে আমাদের কোনো দ্বিধা করার অবকাশ নেই। যেহেতু পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধা, রাজনীতি নিয়ে দ্বিধা এবং পার্টির ওপর মানুষের আস্থাহীনতা ধ্বংস করার জন্য এটা করা হচ্ছে। এটাকে আমরা কোনো দিন মেনে নিতে পারি না। সামনের দিকে এটা আর হবে না। সামনের দিনে সরকার যদি এটা চায়, আমরা রুখে দাঁড়াব।’

এ বিষয়ে কোনো রকম আপস হবে না বলে জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘পার্টিকে ধ্বংস করার ব্যাপারে ওনাকে ব্যবহার করতে আর দেওয়া হবে না। এবং ওনার সঙ্গে কোনো লোককেও আর দেওয়া হবে না। তার জন্য যা কিছু ত্যাগ স্বীকার, সংগ্রাম— সেটা আমরা করব। দল যদি ভেঙেও যায়, তার জন্য আমার কোনো আপত্তি নেই। ওই রকম ভাঙনে আমার কিছু যায় আসে না।’

জি এম কাদের এসব বক্তব্যের ব্যাপারে রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।