১৫ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে ক্ষমতাসীনরা: বিএনপি

১৫ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে ক্ষমতাসীনরা: বিএনপি

সরকারের ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচারে দেশের অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের গত ১২ই অক্টোবর পর্যন্ত (১৫ বছর)  ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, একেবারে লুট। গতকাল সকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিগত ১৫ বছরের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে এসব কথা বলেন তিনি। বলেন, এটা একদম পুরোপুরি একটা ফাঁপা বিষয়। অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো সম্পদকে তারা লুট করে নিয়ে চলে গেছে। সেই সম্পদকে বিদেশে নিয়েছে। 

মির্জা ফখরুল বলেন, এখানে এই লোকগুলোর (ক্ষমতাসীনদের) কোনো নতুন বিনিয়োগ নাই, কোনো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে দারিদ্র্য দারিদ্র্যই থেকে যাচ্ছে এবং মানুষের যে আয়ের ফারাকটা, বৈষ্যমটা দিনে দিনে বাড়ছে। এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন একটা পয়েন্ট অব রিটার্নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে সিপিডি বলছে, এখানে দুইটা সোসাইটি তৈরি হয়ে গেছে, একটা হচ্ছে খুবই বড় লোক শ্রেণি যারা বিদেশে যায়, পোশাক-আশাক, দামী গাড়ি বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ এগুলোতে চড়ছে। অন্যদিকে এই গুলশানেই দেখবেন সিগন্যাল পার্টগুলোতে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তারা তাদের প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। এটাই বাস্তবতা।তিনি বলেন, আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহিতা। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাদের হাতে আমাদের এই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা কোনোকিছুই নিরাপদ নয়। আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান- আসুন বাংলাদেশে একটি সত্যিকার জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং দুঃসহ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করি। তাহলেই ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যাংকিং সেক্টর তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।

ফখরুল বলেন, এই অবৈধ সরকার শুধু রাজনীতিকে নয়, অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধ্বংস করেছে এবং তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে। জনগণ শুধু নয়, আন্তর্জাতিক যে সংস্থাগুলো আছে সেই সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা (সরকার) প্রতারণা করছে। এমন একটা নেরেটিভ খাড়া করেছে যে, বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে গেছে, থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর ডেভেলপমেন্টের জন্য বার বার এই কথাটা বলতে থাকে, জোর দেয় এবং বিভিন্ন সেতু, উড়াল সেতু, টানেল, মেট্রোরেল উদ্বোধন করার মধ্যদিয়ে এই বিষয়টি বলতে চায় যে এটা উন্নয়নের দিকে চলে গেছে।নিমজ্জিত ব্যাংকিং খাত উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট আমাদের অর্থনীতির জীবনী শক্তিকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন কেবলমাত্র দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গ্রুপ তথা ইচ্ছাকৃত লোন ডিফল্টারদের হাতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে।

কমছে এলসি খোলার হার, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে। কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটা এক মহাচ্যালেঞ্জ। তার উপর রয়েছে স্বার্থান্বেষীদের সিন্ডিকেট। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও শেষ। 

অর্থপাচার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার ও তাদের অবৈধ সুবিধাভোগীরা দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর তথ্যমতে, আমদানি ও রপ্তানি পণ্যমূল্যের মিসইনভয়েসিং এর মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ। এভাবে নয় বছরেই দেশ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থপাচারের এই বিপুল স্রোত বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতো। 
রপ্তানির আড়ালেও সম্প্রতি ১৪শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার এবং ইডিএফের আড়ালে ৭শ’ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তার তথ্যাদি তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

ফখরুল বলেন, বিগ থ্রি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৩টি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে। নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে তাতে অর্থনীতি রেড ফ্ল্যাগস-এ উঠে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ ৩ থেকে নামিয়ে বি ১-এ পুননির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত একযুগ পর এই মান কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের রেটিং আউটলুক হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক ঋণমান নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচক ঘোষণা করেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, অবৈধ সরকারের উন্নয়নের স্লোগানের নিচে চাপা পড়েছিল। যা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।

ব্যাংকে নজিরবিহীন তারল্য সংকটের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বেশ কিছুকাল থেকেই তারল্য সংকটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। বিশেষ করে শরীয়াহ ভিত্তিক পরিচালিত ৫টি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। কিন্তু তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক আমানতকারীর নিজস্ব আমানতের এমনকি ১ লাখ টাকার চেকও অনার করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারল্য সংকটের কারণে ‘মূলধন ঘাটতি’ ও ‘আমানতকারীরা ঝুঁকি’র মধ্যে আছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান রবকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন ও নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম উপস্থিত ছিলেন।