মানবাধিকার লংঘনের দ্রুত, পক্ষপাতহীন তদন্তের আহবান

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ

বিশেষ সংবাদদাতা

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গুম, হামলা-মামলা এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় জাতিসংঘের উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে। আর এসব সহিংসতা এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষা করে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার সংস্থাটির মুখপাত্র রাবিনা শ্যামদাসানি এই আহবান জানান। নতুন নির্বাচনের দাবিতে কথা না বলতে দেওয়া, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশি বাধা, মানবাধিকার সংগঠনগুলোসহ সাধারণ মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ না থাকার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। 

নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুর্হূর্তে পাঠকপ্রিয় নিউজপোর্টাল জাস্ট নিউজবিডিসহ ৫৪ টি নিউজ পোর্টাল ব্লক করে দেবারও কড়া সমালোচনা করা হয়েছে বিবৃতিতে। এধরনের পদক্ষেপকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচনে ভোটকারচুপির অভিযোগের মধ্যেই শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এ নির্বাচনের ফলাফলকে দেশটির বিরোধীদলের নেতারা প্রত্যাখান করেছেন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর তদন্ত করা আহবান জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, "বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পূর্বে, চলাকালীন সময় এবং তারপরে যেসকল সহিংসতা এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে তাতে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছে মানবাধিকার কমিশন।"

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র বলেন, "শুধু নির্বাচনের দিনই প্রাণহানি এবং অনেক মানুষ হতাহত হবার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।"

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর প্রতিশোধমূলক হামলা চলমান রয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, "উদ্বেগজনক ইঙ্গিত রয়েছে যে দেশটিতে একের পর এক প্রতিশোধমূলক হামলা অব্যাহত থাকবে, বিশেষ করা সেটা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর। এ হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিকভাবে নির্যাতন, মানসিক হয়রানি, বেআইনী গ্রেফতার, গুম এবং ফৌজদারি মামলা দায়ের।"

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনেরমুখপাত্র আরো বলেন "সহিংস এসব হামলা এবং ভীতি-প্রদর্শনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারাও এতে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।"

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ না হবার কারণ হিসেবে জনগণের উপর আতংক সৃষ্টি, তাদের সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি এবং অন্যান্য অনিয়মের ঘটনাসহ কিছু মিডিয়া রিপোর্টও উপস্থাপন করেছেন রাবিনা শ্যামদাসানি।

সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে খবর প্রকাশ করার জেরে বাংলাদেশ দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে পাস করা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। বিষয়টিকে মুক্ত মত এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করা হয়।

নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে পাঠকপ্রিয় অনলাই নিউজপোর্টাল জাস্ট নিউজবিডিসহ ৫৪ টি পোর্টাল ব্লক করে দেবার সরকারি সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, "নির্বাচনকে সামনে রেখে ১০ ডিসেম্বর থেকে ৫৪ টি নিউজ পোর্টাল ব্লক করে দেওয়া হয়, সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ।পদক্ষেপগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করার নামান্তর।"

নতুন নির্বাচনের দাবিতে করা সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধারও নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। বিবৃতিতে বলা হয়, "নতুন নির্বাচনের দাবিতে করা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভগুলোতেও বাধা প্রদান করছে পুলিশ। এছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন আইনে গ্রেফতার অব্যাহত আছে।"

নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে কথা বলার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে উল্লেখ করে রাবিনা শ্যামদাসানি বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার আন্দােলনের কর্মী-সংগঠন, রাজনৈতিক বিরোধীদলসমূহ এবং সাধারণ জনগণকে নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছেনা।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ মতপ্রকাশে বাধাদানকারী সব আইন সংস্কারের দাবি জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, "মানুষের মত প্রকাশে বাধাদানকারী ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সংশ্লিষ্ট সকল আইনগুলোকে সংস্কার করা উচিত যাতে করে মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষেরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ এবং সভা সমাবেশের সুযোগ পায়। একিসঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে তারা যেনো স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পায়।"

সহিংসতা এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহবান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, "নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব সহিংসতা এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর একটি দ্রুত, স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং কার্যকর তদন্ত করার জন্য এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আহবান জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে কোনোধরণের রাজনৈতিক পরিচয় যেনো কোনো ছাড় না পায়।"

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনও যেন এসব ঘটনা তদন্তে স্বাধীন এবং কার্যকর ভূমিকা রাখে সে আহবানও জানিয়েছে সংস্থাটি।

অবিলম্বের রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক হামলাসমূহ বন্ধের আহবান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, " আর যেনো কোনে প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আমরা আহবান জানাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসমূহ যেন আইনের শাসন অনুসরণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেক্ষেত্র যেনো আইনি বৈধতা এবং ন্যায় বজায় থাকে কর্তৃপক্ষকে তা নিশ্চিত করতে হবে।"

জিএস