ফ্যাক্ট চেক

প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নিয়ে সরকারের মিথ্যাচার: এএফপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নিয়ে সরকারের মিথ্যাচার: এএফপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের লেখা একটি বইকে উদ্ধৃত করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোতে। আর এ মিথ্যাচার যারা ছড়িয়েছেন তাদের নেতৃত্বের সারিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়।

প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ‘অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেজ’ নামে একটি বই লিখেছেন ইংরেজিতে। আর তার বাংলা অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক এবং লেখক মশিউল আলম। শহীদ জিয়াকে নিয়ে ডাহা মিথ্যাচারের বিষয়টি বের হয়ে এসেছে অনুবাদক মশিউল আলমের বক্তব্য থেকেও। তার দাবি অস্ত্রের মুখে জিয়া রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন- এমন কথা মূল ইংরেজি বই এবং অনুবাদের কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ এরকম মিথ্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্রসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম এএফপি বিষয়টির ফ্যাক্ট চেক করে সোমবার একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে তথ্যপ্রমাণসহ উঠে এসেছে যে শহীদ জিয়াকে নিয়ে প্রচারণা আর খবর প্রকাশের বিষয়টি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতি করার প্রচেষ্টা।

এএফপির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্টে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে তারি উত্তরসূরি আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন- এরকম একটি তথ্য বিকৃত করে অবাধে ফেসবুকে ছড়ানো হয়। মূল ইংরেজি বইটিতে জিয়া সম্পর্কে এরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।"

অভিযোগের বিষয়টি সাজানো মিথ্যা বলে তথ্য পেয়েছে এএফপি। বইটির বাংলা অনুবাদক নিজেও সংস্থাটিকে জানিয়েছেন ফেসবুকে এ নিয়ে যা ছড়ানো হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর।

মে মাসের ২৮ তারিখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নামে 'এএলবিডিডটওআরজি' এর একটি ফেসবুক পেইজে এনিমেটেড ভিডিওসহ এ মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। যাতে বাংলায় পােস্ট করা হয়: "আমি কোনমতে সাইন করে জীবন বাঁচালাম- এই কথাটি রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর। তাঁর লেখা ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’ বই থেকে অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায় যা দীর্ঘদিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল বিএনপি। বইটি থেকে আরও জানা যায়, রাষ্ট্রপতি সায়েমের একটাই দুঃখ ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যেতে পারেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া কিভাবে অস্ত্রের মুখে বাংলাদেশের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলো তা জানতে পারবেন এই ছোট এনিমেটেড ভিডিও থেকে। জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েম সাহেবকে কথাও দিয়েছিল সে নির্বাচন এর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সে নির্বাচনে জিয়া সামরিক বাহিনীর প্রধান ও সামরিক আইন প্রশাসক এর পদে থেকে নিজেই নিজেকে হ্যাঁ না ভোট আয়োজন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যা জাতির সাথে সত্যিই এক বড় রকমের তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। জিয়া বঙ্গভবনে আসতেন মধ্যরাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা অস্ত্র উঁচিয়ে রাখতো। আমি প্রায়ই মনে করতাম এটাই বোধহয় আমার শেষ রাত। সংবিধানের ৪ টি মূল স্তম্ভ বাতিল সংক্রান্ত একটি সামরিক ফরমান আমার কাছে স্বাক্ষরের জন্য আসে। আমি ঐ ফরমানে স্বাক্ষর না করে, তা রেখে দেই। পরদিন রাত ১১টায় বুটের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। সেনাপ্রধান জিয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ বঙ্গভবনে আমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। জিয়াউর রহমান আমার বিছানায় তাঁর বুটসহ পা তুলে দিয়ে বলেন, সাইন ইট। তাঁর একহাতে ছিল স্টিক, অন্য হাতে রিভলভার। আমি কাগজটা পড়লাম। আমার পদত্যাগপত্র। যাতে লেখা- ‘অসুস্থতার কারণে আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।’ আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আট দশজন অস্ত্রধারী আমার বিছানার চারপাশে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় পা তুলে আমার বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে বললেন, ‘সাইন ইট’। আমি কোনোমতে সই করে বাঁচলাম।"

এদিকে, এএফপি তাদের ফ্যাক্ট চেক করে প্রতিবেদনে বলেছে, "সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন বিভ্রান্তিকর এতথ্য ফেসবুকে ছড়ান। যার মধ্যে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এবং ছেলে জয়, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ রয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেইজেও এটা ছড়ানো হয়। আর বানােয়াট এ তথ্য নিয়ে খবর প্রকাশ করে সময় টিভি, চ্যানেল আই, বাংলা ট্রিবিউন, নিউজ বাংলা ২৪ ডটকম এবং সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস। মে ২৫ তারিখ বানোয়াট এসব তথ্য নিয়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন শেখ হাসিনার ছেলে জয়।"

প্রেসিডেন্ট সায়েমের লেখা মূল বই ঘাঁটাঘাটি করে দেখা যায় ছড়ানো তথ্যটি মিথ্যা, জানিয়েছে এএফপি। আন্তর্জাতিক এ বার্তা সংস্থাটি বলেছে, "১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বইটিতে জিয়ার কথা আছে কিন্তু ফেসবুকে যা ছড়ানো হয়েছে সেরকম কোন কথা সেখানে নেই।"

প্রেসিডেন্টে সায়েমের মূল ইংরেজি বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় কী লেখা আছে তা স্ক্রীনশটসহ ইংরেজি অংশটুকু প্রতিবেদনে ছেপেছে এএফপি। যাতে প্রেসিডেন্ট সায়েম লিখেছেন, "দিনটি ছিল ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। বিশেষ সহকারির নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সিনিয়র সদস্য আমার কাছে আসে। আমি যেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেই সে অনুরোধ করে। তারা আমাকে বলে- আমরা জিয়াউর রহমানের (তৎকালীন সেনাপ্রধান এবং সিএমএলএ) নেতৃত্বে কাজ করতে চাই। সিভিল প্রশাসনে থেকেও লোকজন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কাজ করতে চায়- বিষয়টা কী এভাবেই স্পষ্ট হয় না? সেসময়টাতে একরকম দ্বিধাদ্বন্দের ভিতরেই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াবো।"

সাংবাদিক মশিউল আলম প্রেসিডেন্ট সায়েমের এই আত্মজীবনী ১৯৯৮ সালে বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি এএফপিকে বলেন, "ফেসবুকে যেটা ছড়ানো হচ্ছে তা সাজানো মিথ্যা। আমিই বইটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছি। ফেসবুকে যা ছড়ানো হলো সেরকম কোন কিছু মূল বইয়ে ছিলোনা।"

এএফপি বইটির বাংলা এবং ইংরেজি ২ টি কপিই ফ্যাক্ট চেক করে জেনেছে যে ফেসবুকে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্যের অস্তিত্ব-এগুলোতে নেই।

বাংলাদেশের খ্যাতনামা ইতিহাস লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এএফপিকে বলেন, "সায়েম তার আত্মজীবনী বইয়ে কোথাও একথা বলেননি জিয়া বন্দুকের নলের মুখে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। আমরাও এ ধরনের তথ্য কোথাও খোঁজে পাইনি।আর্মির কোন প্রয়োজন ছিলোনা তাকে বন্ধুকের নলের মুখে পদত্যাগ করানোর। কারণ তারাই তাকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলো। আর্মি প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চায় এটা শুধু তাদের মুখের বলা কথাতেই হয়ে যেতো।"

এনবি/